ফিলিস্তিনিদের গল্প
এ শুধু গল্প নয়, ফিলিস্তিনিদের জীবনের কথা। নারী ও তার সন্তান জন্মদানের রূপকের মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের দুঃসহ জীবন ও স্বপ্নের কথা বলা হয়েছে এই দীর্ঘকবিতায়। নাটকীয় ভঙ্গি আর এপিকতুল্য বলা যায় কবিতাটিকে। – অনুবাদক
দৃশ্য ১ : গর্ভবীজের শল্যচিকিংৎসা
তার কথা ভাবো
তারা তোমার শিকল আলগা করে দিল
তারা তোমাকে নিচে নামাল
তোমার পায়ের শুকতলা তলা
রক্তমাখা মাটি স্পর্শ করল
তার কথা ভাবো
যেহেতু তারা তোমাকে জেরা করবে বলে চেয়ারের সঙ্গে
নগ্ন করে বেঁধেছে
জলে ভাসতে ভাসতে
যখন তুমি বাতাসের জন্য হাসফাস করছ
তখন তার কথাই ভাবো
মারধরের পর
তার কথা ভাবো
নির্যাতনের পর
তার কথা ভাবো
তোমার বন্দিসেলে তুমি একা
ভাবো… ভাবো… ভাবো… ভাবো…
সেই নারীর কথা ভাবো
তারপর চকলেটের মোড়কে তোমার ভালবাসার বীজ খালি হয়ে গেল
এবার পুরুষটির কথা ভাবো
তোমার পোশাকের ভাঁজে একটা লুকানো মোড়ক
সশস্ত্র প্রহরীরা তোমাকে ঠেলে বাসে তুলে দিচ্ছে
ভিজিটিং আওয়ার শেষ কিন্তু তোমার আশা-আকাঙ্ক্ষাগুলো প্রসারিত হয়ে আছে অতীতে
যে কুকুরগুলি ঘেউ ঘেউ করছিল… যে কুকুরগুলিকে গুলি করা হয়েছে
সেই কুকুরদের দেখ
ভাবো সেই পুরুষটির কথা
তোমার বাড়িতে কত কত মহিলা যে জড়ো হয়েছে
ভাবো তার কথা
তারা ড্রাম পিটিয়ে দিয়ে শব্দ করল, গান গাইল আর নাচল
তার কথা ভাবো
যখন তারা প্রেম এবং রোমান্সের গল্প উল্টেপাল্টে বলল তখন
তার কথা ভাবো
যখন তুমি বিছানায় শুয়ে থাক তখনও তার কথা ভাবো
পা ফাঁক করে তার কথা ভাবো।
যখন তুমি চকোলেটের মোড়কটি খোলো
ভাবো… ভাবো… ভাবো… ভাবো… ভাবো… ভাবো…
এরপর নির্ভেজাল মহিয়ান ভাবনার ভেতরে ঝাঁপ দাও
দৃশ্য ২ : দুজনের জন্যে গোপন কিছু
লোহার দণ্ডগুলিকে দুই হাত দিয়ে আলিঙ্গন কর
পুরুষটির দৃষ্টি প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়ার জন্যে নারীকে খুঁজছে
কিন্তু তুমি কি খুঁজছ
কিন্তু আমরা খুঁজছি
আমিও কি খুঁজছি কিছু
আমরা
তার কথাগুলো নীরবে ফিসফিস করছে
তোমার জন্যে আমি প্রতিশ্রুতি বহন করে এনেছি
আমার ভেতরে সেটা আটকে আছে
একটি অনন্ত পৃথিবীর মধ্যে
গোপন ক্ষণস্থায়ী অনাস্বাদিত মুহূর্তগুলো ভাসছে
সন্তানের জন্মদাত্রী নারীর জন্য
পুরুষটি গভীর রাতে গান গাইছে
আমি প্রত্যাশার প্রান্তে নেচে চলেছি
এবং যখন বাতাস আমাকে ছুঁয়ে বয়ে চলে
তোমার জন্যে হৃদয়ের কাছে নমিত হয়ে সুর তুলি
যেন সে কোনো কোমল সিম্ফোনি
দৃশ্য ৩ : অপেক্ষা
আমি তোমার জন্যে অপেক্ষা করি
আমি তার জন্যে অপেক্ষা করি
তোমার ভেতরে আমি তার জন্যে অপেক্ষা করি
তোমার চুলে তার কোকড়ানো চুল
তোমার চোখে তার চোখের বাদামি
তোমার হাসিতে তার মুক্তো
তোমার আলিঙ্গনে তার ভালোবাসা
তোমার হৃদয়ে তার সাহস
তোমার পদচিহ্নে তার ক্রোধ
তোমার মমতার মধ্যে তার কোমলতা
আমি পুরুষটির জন্যে অপেক্ষা করি
আমি তোমার মধ্যে তার জন্যে অপেক্ষা করি
বাচ্চাদের খেলা দেখে আমি সময় পার করি
দেয়াল আর ওয়াচ টাওয়ারের মধ্যে
চেকপয়েন্টের জন্য আমি অপেক্ষা করে সময় পার করি
ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করি
আমি কারফিউ গুনতে গুণতে সময় পার করি
রাতে কতবার তারা হানা দিল গুণে দেখি
গ্যাসের কয়টা ক্যানেস্তারা আর রাবার বুলেট ছোঁড়া হলো
কজন শহিদ হলো আমি গুণতে থাকি।
আকাশের দিকে তাকিয়ে সময় পার করি
অনেক জিজ্ঞাসার জবাব আকাশে খুঁজতে খুঁজতে
অপেক্ষায় থাকি
আমি তোমাকে একঝলক দেখার জন্যে অপেক্ষা করি
অপেক্ষা করি
অপেক্ষা করি সেই পুরুষের জন্যে
অপেক্ষা করি তোমার ভেতরে তাকে দেখার জন্যে
দৃশ্য ৪ : জন্ম – কেস # ৭০
এভাবে হবে আমি কল্পনাও করিনি
রক্তেভেজা ময়লার ওপর পা দুটো ফাঁক হয়ে গেঁথে গেছে
অচেনা লোকগুলো আমার স্কার্টের ওপর গড়াগড়ি খাচ্ছে
কতকগুলি হাত আমার অন্তর্বাস টেনে খুলছে
বন্দুক আর ফোন আমার দিকে তাক করা
জাতিসংঘের পর্যবেক্ষকরা অসম্মানিতদের সংখ্যা গুণে দেখছে
তারা আমার নামটা লিখছে
লিখে আমাকেও নিচে নামাচ্ছে… একটা সংখ্যা মাত্র
আমার কেস # ৭০
আমার আগে আছে আরও ঊনষাট জন মহিলা
একজন নয়… দুজন নয়… তিনজন নয়
আমি শক্তি সঞ্চয় করছি এবং সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ করছি
ফিরিয়ে দিচ্ছি তাদের নিষ্ঠুরতা
আমি আবর্জনার স্তূপের উপর পড়ে থাকা নেড়ি কুকুর নই
যে অ্যাম্বুলেন্সটা তারা আটকে দিয়েছে সেটা আসছিল আমারই জন্যে
আমি হাসপাতালের একটি কেবিন বুক করেছি
আমি একটা নার্সারিকে সাজিয়েছি
এমনকি দুশ্চিন্তা দূর করার জন্যে কারা গান গাইবে
তাদেরও একটা তালিকা করেছি
কিন্তু এর সবই বৃথা গেল
আমার কেস # ৭০
আমি ধাক্কা দিচ্ছি… ধাক্কা … ধাক্কা…
আমি কি কিছুই গোপন রাখতে পারব না?
আমি হাজার মাতৃপতির জ্ঞান
দশ লক্ষ উদ্বাস্তুর ধৈর্য ধারণ করে আছি
আর প্রতিরোধ করছি ভয় এবং নির্মমতাকে
সুঘ্রাণ নিচ্ছি নেবু ও জুঁইয়ের
তোমার ত্বকের উষ্ণতা
তোমার দেহের কোমলতা
অবশেষে আমার কাছ থেকে সরে সরে যাচ্ছে
আমি এই অমানবিকতার মধ্যে শ্বাসপ্রশ্বাস নিচ্ছি
অশ্রু ও ক্রোধের মধ্য দিয়ে চলেছি
এমন যে হবে আমি কল্পনাও করিনি
আমার কেস #৭০
আমি তোমার ভেতরেই শ্বাসপ্রশ্বাস নিই
সবকিছু শূন্যে বিবর্ণ হয়ে যাওয়া পর্য়ন্ত
তুমি আর আমি সেখানে না থাকা পর্য়ন্ত
নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস নিতে থাকি
এবং তখন দেখি সব আছে… তুমি আর আমি
আমি তোমাকে আমার মাথার স্কার্ফ দিয়ে জড়িয়ে রাখি আর
তোমার কানে কানে ফিসফিস করে প্রার্থনা জপ করি
তুমি অবিচল থাকতে পার
তুমি তো নবী
তোমার ভাবনাকেই প্রতিরোধ বলা যায়
এর স বই
ঈশ্বরের মতো পবিত্র
প্রতিরোধের মতো মধুর
ত্রাতার মতো মহান
সামাহ সাবাভি
ফিলিস্তিনি-অস্ট্রেলীয়-কানাডিয়ান নাট্যকার ও কবি। ‘নগরের গল্প’ নাটকটির জন্য তিনি পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। সাবাভি তাঁর নাটকগুলি উৎসর্গ করেছেন ঔপনিবেশিকতার ভয়াবহতা এবং নির্বাসনের তিক্ততা ও প্রতিরোধ নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের উদ্দেশে।