সেই বাড়িতে ফুলের বাগান নেই। বাগান করবে কোথায়! জমিই তো নেই! থাকার মধ্যে রয়েছে একটা ছাদ। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো সেই চৌকো ছাদে উঠবার সিঁড়িও নেই। ছাদ এবং আকাশের আশনাই শুনে অন্ধকার বাসিন্দারা কখনো মাথা ঘামায়নি। কিংবা মাথা ঘামালেও সংগতিহীন পিতার মতো ‘ও জিনিস মোটে ভাল নয়’ বলে হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে।
তবে সেই বাড়িতেও সুদূর ভবিষ্যতে ফুলের বাগানের স্বপ্ন দেখেছিল কেউ। নইলে কেনই বা এ হেন বাড়ির নাম রাখবে ‘পুষ্পক্ষেত্র’! বাড়িটার কালচে হয়ে আসা হলদে রঙে সিমেন্ট দিয়ে অতিযত্নে লেখা এই নামে রোদ পড়ত, বৃষ্টি হত, সন্ধে নামত।
সন্ধে হওয়া দেখতে আমি সেই বাড়ির কাছে যেতাম। ভিতরে চিরকালীন আবছা অন্ধকার। মরচে ধরা গ্রিলের ভিতরে বসে থাকতেন এক বৃদ্ধ। তখন আমার শহরকে ঘিরে ধরছে সেরেলিয়ান ব্লু। প্রতিটি বাড়িতে, পথচলতি মানুষের মুখে, ছোটো ছোটো যানবাহনের গায়ে সেই রঙের আভা ঢুকে পড়ছে আপাত শান্ত পায়ে। আলো না জ্বালাবার এবং আলো জ্বালাবার সন্ধিক্ষণে আমি দাঁড়াতাম সেই বাড়ির সামনে। বৃদ্ধ কাশতেন। একবার কাশি শুরু হলে আর থামতে চাইত না। ভিতরে লো ভোল্টেজের টিউব জ্বলে উঠত। একটা দুটো বাড়িতে শাঁখ, কাছের ছোট্ট মন্দিরে কাঁসর বাজত। আচমকা সাইকেলে ব্রেক কষে দাঁড়াতাম। বৃদ্ধের জল ভরা চোখের কাছে, কাশির শব্দে আর ফুল ফোটানো সন্ধেয় আমি খুঁজতাম মাতব্বররের দুনিয়া।
আমার অপেক্ষার কারণ ছিল। হেমন্ত শুরুর সেইসব দিনে একটিমাত্র মুখের অপেক্ষায় এই যে আমার দাঁড়িয়ে পড়ার বাহানা, এই যে আমার উপস্থিতি জানান দিতে আসা, এর ভিতরে কোনো বাহাদুরি ছিল না। কাঁচা মায়ার আকর নিয়ে ঘুরে বেড়ানো আমি শুধু দুনিয়া খুঁজতে যেতাম।
সেই ছেলেটার এক দুনিয়া ছিল বটে! যে পৃথিবীর স্বাদ পাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তার দুনিয়ায় দূরপাল্লার রেল ছিল, একা একার মহানগর ছিল, অন্য শহরে হারানোর স্বাধীনতা ছিল। আমার ছিল সে।
নভেম্বরের শুরুতে গড়িমসি প্যান্ডেল বেঁধে যেত কেউ। ওরা রাত জাগত, ওরা আনন্দের তাড়াহুড়োয় কাজ সারত, উৎসবে মিশত চিরকাঙ্ক্ষিত শীত। শুধু আগের দিনগুলোয় বেঁধে রাখা ম্যারাপে অন্ধকার লাগলে দেখতে যেতাম আমি।
কালীপুজোর আগে আমার মফস্বল কেমন পাল্টায়, কী মনকেমন বয়ে নিয়ে আসে দেখতে এ গলি সে গলি ঘুরে ফিরে সেই বাড়ির ধারেই যেতাম। তখন শিরশিরে শীতে রেওয়াজে বসত কেউ। কী যে গাইত, কোনদিনও খেয়াল করিনি। কারোর ঘরে রান্নার শব্দ, কারোর ঘরে পড়া মুখস্থ গুনগুন, আর কারোর ঘরে বৃদ্ধের শেষ না হওয়া কাশি… এসবের ভিড়ে গন্ধরাজ ফুল ফুটত। অপেক্ষা সহনীয় হত।
কোনো কোনো দিন তার দেখা পেতাম। ধোপদুরস্ত পোশাকে ঘাম, ক্লান্তি, আর অবাক হওয়া মুখ। অন্য শহরের গল্প শুনতে দাঁড়িয়ে যেতাম। কেমন করে সে একাই বাসরাস্তা চেনে! কেমন করে সে কলকাতার ভিড়ে হারিয়ে যায় না, কেমন করে যে সে দেশ বিদেশের গল্প জানে, কত কত তার বন্ধু অন্য শহরে থাকে… বিস্ময়! বিস্ময়!
‘আজ কী হল জানিস…’ কী হল, চোখের সীমানা ছাড়ানো দুনিয়ায় রোজ কী হয়, তা জানতেই তো আসা।
আমাদের শহরে খিদের মুখে, বড়ো হওয়ার যন্ত্রণায়, আরেকটু বড়ো ভাবের চেষ্টায় এদিক সেদিক কাগজি ফুল ফুটছিল। গন্ধরাজ ফুল সন্ধে আনছিল, বিকেলের মানে অন্য ছিল, একের পর এক বাড়ি ভাঙা পড়ছিল, নদীর ঘাটে মেলা বসছিল, আর জীবন শরতের দুপুরের মতো শান্তভাবে বইছিল।
এই শহরে আমাদের আরেক গানের বাড়িও ছিল। সেই বাড়িটার গল্পও বলা যাক। তার জমির অভাব ছিল না, ঘরের অভাব ছিল। বাড়িটা ছোট্ট, ওপরে করগেটেড শিটের চাল, জল পড়া আটকাতে কালো পিচচটের পর্দা ছাওয়া, আর আশেপাশের নতুন নতুন রঙের বাড়ির কাছে বেমানান। উঠোনে ভেঙে ভেঙে যাওয়া বেড়ায় বন্দি ছিল ছোট্ট তুলসিমঞ্চ। আমাদের সাইকেল রুটে প্রায়ই সন্ধের মুখে দেখতাম প্রৌঢ়া তুলসিমঞ্চে ধূপ দেখাচ্ছেন। এবং আমাদের দেখে কৌতুকী হাসি ছুঁড়ছেন। এই বাড়িটায় কিছুই ছিল না। ছিল শুধু একটি রেডিও। রেডিও সারাদিন বাজত। নতুন, পুরনো বাছবিচার ছিল না, ভোর থেকে শুধু গানই বাজত। নিঃসন্তান ওঁদের ঘরে বৃষ্টি পড়েছে কত, কিন্তু গান বন্ধ হয়নি।
সে’বারে দু’দিন অভিমানের বেলা চলছিল। অভিমান হলে সন্ধে নামা দেখতে যেতে নেই। তখন আমি সাইকেল ঘুরিয়ে নিচ্ছিলাম। সাথে মুখও। তখন আমরা একই শহরে একা একা ঘুরছিলাম। আমাদের রাস্তা ও সময় আলাদা করে নিয়েছিলাম। সেদিন মুখভার ভোরে উঠে কোচিং যাওয়ার পথে দেখি গান নেই। অদ্ভুত ঠেকল। হয়ত তাঁদের মনখারাপ আমারই মতো। রোদ উঠলে মন ভাল হবে ভেবে চলে গেলাম। ফিরতি পথেও দেখি গান নেই। কে কার ওপর অভিমান করে গান থামিয়েছে কে জানে!
একদিন কেটে গেল। পরদিন বেলায় দেখি কী ভিড় কী ভিড়।! একটা সাইকেল ভ্যান ঘিরে রাজ্যের ভিড়, কান ফাটানো গুনগুন। সাইকেল ভ্যানে পাশাপাশি ঘুমিয়ে দু’জন গানের মানুষ। তাঁদের পায়ের পাতায় চাপ চাপ জামাট রক্ত।
সেই দিন প্রথম জানলাম খিদে পেলে সুর খাওয়া যায় না। আসলে বড্ড অভাব ছিল তো… কখনো রঙিন ফুলছাপ সুতির পোশাক, কখনো ধূপকাঠি, কখনো ঝুটো গয়না বেচে চলছিল। বেমানান পাড়ায় কেউ নিত না ঝুটো গয়না, খুলে আসা সেলাইয়ের সস্তা বাঁধুনির পোশাক। ওরা ভোর থেকে গান বাজিয়ে ঢেকে রাখত সেই উপেক্ষা। ওঁদের দেহ জুড়ে দীর্ঘদিনের খিদের গন্ধ উথলে উঠল বলেই না পাড়া জানল!
হাটখোলা কালো দরজার ভিতরে চোখ রেখেছিলাম সেই প্রথমবার। রেডিও নেই, চাল থেকে ঝুলছিল গিঁট খোলা দুটো শাড়ি। শুধু এই খবরটুকু দিতে সেদিন সন্ধে নামার পাড়ায় গিয়েছিলাম আমি।
আমাদের মধ্যেও গান ফুরিয়ে আসছিল। ‘পুষ্পক্ষেত্র’-র কাছে দাঁড়াতে অসুস্থ লাগত। আমার ক্লান্তি বাড়ছিল। গন্ধরাজ একইভাবে ফুল ফোটাত, তবু আমার মুখ শুকিয়ে আসছিল। মরচে-ধরা গ্রিলের ওধারে বৃদ্ধ কী বুঝতেন জানি না, বিস্ময়ের চোখে আমাকে দেখতেন। অসুখের পদশব্দ টের পাওয়া যায়? হয়ত পেয়েছিলেন।
আমি আর তার দেখা পেতাম না। অন্য শহরের গল্প বলতে বলতে সে অন্য কোথাও হারিয়ে যাচ্ছিল কি না জানা নেই, আমার অসুখ বাড়ছিল। গান বন্ধ হওয়া পাড়ায় নিশ্চুপে হাঁটা শুরু করেছিলাম, বেশিদিন হেঁটে যেতে পারিনি।
অসুখের ঘুম ভাঙলে চুপ করে শুয়ে রেলস্টেশনের রাস্তা ভাবতাম আমি। অ্যাম্বুলেন্সের কান্নার ভিতর যে ভয় থাকে, সেই ভয়ের সবটুকু নিয়েও চলন্ত জানালার বাইরে চোখ রাখতাম। আমি নতুন খোপে মহানগর দেখছিলাম। চেনা গলায় দেশ বিদেশের গল্পবলা মানুষ ধীরে ধীরে অদৃশ্য হচ্ছিল। অবশেষে আমার শহর দেখার গল্প বলার সময় এলে আর কাউকে পাওয়া গেল না। চেনা চেনা বাড়ির পথ আমি ছেড়ে দিলাম।
একদিন ঘুম ভেঙে দেখি প্রতিবেশী মহিলার পিছে দাঁড়িয়ে এক মেয়ে। আমার চেয়ে একটূ বড়ো, তার একঢাল কালো চুল, গায়ের রং দুধে আলতা। সে আমার দিকে এমনভাবে চেয়ে রইল, যেন খুব কৌতূহলে এক কঙ্কালসার জন্তু দেখতে এসেছে। প্রতিবেশী মহিলা বললেন, ‘ও সুষমা, আমার দাদার মেয়ে। এসএসসি শেষ হল বলে কুমিল্লা থেকে এসেছে। ’
‘এসএসসি’ শব্দের সাথে অন্যভাবে পরিচিত ছিলাম। পরে জানলাম, সুষমার কাছে এর অর্থ মাধ্যমিকের মতো। আমার ভারি ঈর্ষা হল। কুমিল্লা! সে যে অন্য দেশ! আমারই বয়সি মেয়ে অন্য দেশ দেখতে চলে এল, আর আমি কিনা অ্যাম্বুলেন্সের ভিতর থেকে কলকাতা দেখি শুধু!
সুষমা আমার মন ভাল করতে ওর দেশের গল্প বলত। কোনো কোনো দিন আমি জেগে থাকলে আমার চুল আঁচড়ে দিত। ঘুমিয়ে থাকলে শুনেছি সিঁড়ির মুখে দেখে চলে যেত। আত্মীয়ের ভিড়ে ঘর সরগরম থাকলেও ছুটে পালাত। যে দেশে সুষমা বেঁচে থাকে, সেইসব অন্য দেশের গল্প আমার অসুস্থ চোখ দুটোয় কত কী দৃশ্য খুলে দিত। যেন তারই ইস্কুলের মাঠ ঠিক আমার দেশের মতো নয়। যেন তারই দুপুরের ভাত আমার মতো নয়। অথচ সবই এক ছিল। সীমানায় কি ভাবনা আলাদা হয়? বোঝার মতো বয়স ছিল না আমার।
একদিন একটু সুস্থ হয়ে সুষমাকে চুপি চুপি বললাম, ‘আমার ভারি মনখারাপ করে। একজন মানুষ ছিল, দেশ বিদেশের গল্প বলত, এই তোমার দেশের গল্পের মতো। এখন আর সে আমার সঙ্গে কথা বলে না জান!’
সুষমা চুপ করে রইল। আরেকটু ভেবে আমি বললাম, ‘এই যে আমি তোমার মুখে তোমার দেশের এত গল্প শুনি, এসব তো আমার তাকে বলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কথা না বললে এত গল্প বলি কী করে বল!’
সুষমা আমার চুলে, কানে, গালে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, ‘আমার ছুটি শেষ হয়ে গেলে তো চলে যাব, তুমি কিন্তু সেরে উঠে আমাদের শহরে এস। আসবে কিন্তু, তোমাকে ঘুরিয়ে আনব।’
আহ, সেই মুহূর্তে এক ঝটকায় বাঁচতে কী যে ইচ্ছে হল! অন্য দেশের অন্য শহর দেখতে যদি একবার সেরে ওঠা যায়! দিন চারেক পর সুষমা কুমিল্লা চলে গেল। আমি তার মফস্বল শহরের নাম মনে রাখিনি।
এখন সুষমা কোথায় আমি জানি না। জানতে পারলে বলে আসতাম, ‘আমি সুস্থ হয়ে গেছি, কাছেপিঠের পৃথিবী একলা চষে বেড়াই। ’তাকে আর কোনোদিনও দেখিনি। দেখতে পেলে চিনতে পারব না। কিন্তু চেনা দিলে বলব, ‘গানের বাড়ি ভাঙা হয়েছে জান! এখন সেখানে জলের কারখানা। জল বন্দি করে করে দূরের দেশে পাঠানো হয়। ‘পুষ্পক্ষেত্র’ আরও বৃদ্ধ হয়েছে, জান। ফুলের বাগান বা সিঁড়ি, কোনটাই হয়ে ওঠেনি। মরচে-ধরা গ্রিলের ওধার ফাঁকা।’
সুষমাকে আর কখনো দেখব না জানি। দেখতে পেলে বলতাম সেই সন্ধের গল্প, যখন সেই হারিয়ে যাওয়া মানুষ দেখি বয়সের মেদে বুড়িয়ে গেছে। চোখে কোথায় দেশ! বিদেশই বা কোথায়! তাকে ঘিরে থাকে তার দুনিয়া… শান্ত নিঃস্পৃহ স্ত্রী, কচি সন্তান। সে সন্ধের সস্তা বাজার করে, রিক্সা স্ট্যান্ডের লাইনে দাঁড়া্য়, মাসের শেষে হাঁটে, চৈত্র সেলের দরদাম নিয়ে ভিড় ফাটিয়ে ঝগড়া করে। আর সন্ধের পথে মাঝেমধ্যে আমাকে দেখলে চমকে ওঠে।
আর কেউ না জানুক, সেই অন্য দেশের মেয়ে জানত, এই ঘুরতে আসা শহরখানা আমার বয়ঃসন্ধির মেয়ে। সে পাল্টাচ্ছে দ্রুত, তার বদলে যাওয়ার তালে তাল মেলাতে বদলাচ্ছি আমিও। ভাঙচুর শিখিয়ে দিতে দিতে তার মাথায় হাত রাখছি আমি।
গন্ধরাজ ফুল ফোটায় এখনও। আমার নীল সাইকেল চুরি হয়ে গেছে কবেই, সন্ধের একলাভাব কাটাতে দূরে দূরে হেঁটে যাই। নতুন দোকানের ধারে টিমটিমে পুরনো দোকান। তারও কোণে অন্ধকার। পরিজন কমে আসা কোনো এক বাড়িতে এখনও কাগজি ফুল ফোটে। পাল্টে যাওয়া মুখ এই শহরেই থাকে।
বিস্মিত হই! এই শহরে আমি এখনও বেঁচে আছি… ‘হাতে রুপালি ডট পেন, বুকে লেবুপাতার বাগান’।
কথাসাহিত্য
ছোটগল্প
বিশেষ সংখ্যা
‘হাতে রুপালি ডট পেন, বুকে লেবুপাতার বাগান’ অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছোটগল্প উৎসব সংখ্যা ১৪৩০
- June 9, 2023
- 0 Comments
- 400 Views
Leave feedback about this