শুকতারা বলে, রেজা এসেছে খানিক আগে।
সামনের রুমের বিছানায় বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে আছে। রুমের পাশেই ব্যালকনি। তাতে টবে নানারকম ফুলগাছ, চায়না রোজ, পুর্তলিকা, রেইন লিলি। আরো আছে ক্যাকটাস।
শাহেদ সেদিকে চেয়ে শুকতারার রুমে ঢুকে পড়ে।
আজ অফিস খোলা। এত সকালে সে শুকতারার ঘরে আসে না। রুমে ঢুকে শাহেদ পালংয়ের ডালায় বালিশ দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে। শুকতারাও পিছু পিছু এসে পালঙে বসে। এ ঘরটা শুকতারার শোবার ঘর। তার নিজস্ব জগৎ বলতে কিছু থাকলে এ ঘরটাই আছে। দেয়ালে কাগজ মন্ডের বড় মুখোশ ঝুলানো। তার সাথে চারুকলায় পড়ত তৌফিক, মাস্টার্সের শেষ ক্লাসের দিন উপহার দিয়েছিল মুখোশটা। বলেছিল, স্মৃতি হিসেবে থাক। চারুকলার সামনের মাঠে তৌফিককে মুখোশ বানাতে দেখে বলেছিল, কি সুন্দর!
অনেকদিন তার সঙ্গে দেখা হয় না। মাঝখানে বিজ্ঞাপন-চিত্র বানিয়েছিল। ঢাকার বনানীতে আলাদা ফ্ল্যাট নিয়ে থাকত। এখন মন্দিরে মন্দিরে ঘোরে। বাংলা বর্ণমালা, ধ্বনি আর তার দর্শন নিয়ে বই লিখছে। নিজের নাম বলে ব্যোমনাথ।
খাটে বসে শুকতারা আবার বলে, রেজা এসেছে খানিক আগে। শাহেদ হাসে। তার হাসিটা সুন্দর। শুকতারা জানে, শাহেদের চোখের দিকে তাকিয়ে বোঝা যায় না সে কী ভাবছে। দেখে মনে হবে কিছুই ভাবছে না, অথচ ভেতরে ভেতরে ভাবনায় একটার পর একটা গিঁট পড়ছে।
সকালে যখন কথা বললাম, তোমাকে অনেক খুশি খুশি মনে হচ্ছিল। শাহেদ বলে।
শুকতারা বলে, সব তোমার মনে হওয়া। গলা শুনে কি মন বোঝা যায়?
শুকতারা স্কুল টিচার। শনিবার তার স্কুল বন্ধ।
পালঙে আধশোয়া হয়ে বসা শাহেদের হাঁটুতে হাত রাখে সে। হাতের উপর থুতনি ঠেকায়। তারপর তার দিকে তাকিয়ে বলে, তুমি যখন ডোরবেল দিলে, আমি ব্যালকনিতে গাছের যত্ন নিচ্ছিলাম। রেইন লিলিগুলোর গোড়ার মাটিতে পিঁপড়া এসেছে।
শুকতারার ফ্ল্যাট তিনতলায়। আশেপাশে আর কোনো উঁচু বিল্ডিং নেই। পেছনের দিকে অনেকখানি জায়গা জুড়ে বড় জামগাছ। সেমিপাকা ঘর।
শাহেদ খোলা জানালা দিয়ে দেখে, হাওয়ায় জামপাতা দোল খাচ্ছে। জামপাতা থেকে চোখ ফিরিয়ে শুকতারার দিকে তাকিয়ে বলে, রেজা আজ সকাল সকাল এখানে!
শাহেদ আর শুকতারা একসঙ্গে পড়েছে। ভার্সিটিতে। কলেজে থাকতেই শুকতারার বিয়ে হয়। স্বামী ব্যাংকের ক্লার্ক। ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে শুকতারারও স্কুলে চাকরি হয়ে যায়।
আজ এ এলাকায় তার মার্কেটিংয়ের কাজ। শুকতারা বলে।
রেজা শুকতারার কাজিন। শুকতারার বাসাতেই রেজার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল।
ইদানীং ঘন ঘন তোমার বাসায় আসছে মনে হয়? গত সপ্তাহেও তোমাদের পাড়ার বাজারে দেখা হয়েছিল। শাহেদ বলে।
শুকতারার মেয়ে অর্পা মেডিকেলে পড়ে। সে ক্লাসে। স্কুলের চাকরিতে জয়েন করার বছরখানেক পরেই শুকতারার সঙ্গে তার স্বামীর ডিভোর্স হয়ে যায়।
ওর গার্লফ্রেন্ডের সাথে সারারাত নাকি ঝগড়া হয়েছে। শুকতারা বলে।
শাহেদ বলে, কার গার্লফ্রেন্ড?
শুকতারা বলে, রেজার।
শাহেদের কপালে ভাবনার গিঁট পড়ে। শুকতারা বলতে থাকে, সে কথাই কাঁদতে কাঁদতে আমাকে বলল।
রেজা শুকতারার চেয়ে অনেক ছোট। প্রায় বারো বছরের ছোট। শুকতারার ঘরের পাশে ব্যালকনি আরো খোলামেলা। শাহেদ পালং থেকে উঠে ব্যালকনিতে দাঁড়ায়। রাস্তার ওপারে রেলওয়ের বড় পুকুর। পুকুরের পশ্চিম পাড়ে লাল কৃষ্ণচূড়া গাছ। রাস্তায় লাউয়ের ভ্যানগাড়ি যায়। লাউয়ের সবুজে ভ্যানগাড়ি সবুজ হয়ে আছে।
ব্যালকনি থেকে প্ল্যাটফর্মের টালিরং চাল দেখা যায়।
শুকতারা ভাবে, শাহেদ কী ভাবছে?
ডিভোর্সের পর শাহেদ চেয়েছিল তাকে বিয়ে করতে। রাজি হয়নি সে। বলেছিল, তোমাকে ভালোবাসি, কিন্তু বিয়ে করতে আর ইচ্ছে করে না।
ব্যালকনির দরজায় দাঁড়িয়ে শুকতারা জিজ্ঞেস করে, চা করে আনি?
ব্যালকনির গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়েছিল শাহেদ। শুকতারার গলা শুনে তার দিকে তাকায়। হাসে। বলে, দাও। রেজা কি কেবল তার গার্লফ্রেন্ডের গল্পই করে? ভাবে শাহেদ। গত মাসে যখন এসেছিল তখনো রেজার সঙ্গে দেখা হয়েছিল তার। অর্পাও বাসায় ছিল। রেজার সঙ্গে বাহুতে বাহু লাগিয়ে মোবাইলে ছবি দেখছিল শুকতারা। চোখে অন্যরকম দ্যুতি।
আজও সামনের রুমে রেজাকে দেখে জাল দেওয়া পুকুরের শাপলা পাতার মতো তার ভেতর এলোমেলো হয়ে যায়। ধান কেটে নেওয়া বিলের মতো মনটা হু হু করে ওঠে।
শুকতারাকে কি সে কিছু জিজ্ঞেস করবে? এ সময় উত্তর দিক হতে একটা মেইল ট্রেন আসে।
চা বানাতে বানাতে শুকতারা নিজের ভেতর অপরাধবোধে ভোগে। রেজা কি আদৌ ঘুমাচ্ছে? সে জানে, বালিশের ভেতর মুখ লুকিয়ে শুয়ে আছে। তার চোখ নিশ্চয় ফোলা ফোলা। কান্নায় লালচে। গার্লফ্রেন্ডের জন্য কি আসলে সে কান্না করছিল?
আজ অনেক ভোরে এসেছে রেজা। অর্পা তখনো বেরোয়নি। সে উঠে কেবল নাস্তার আয়োজন করছে। তখনি ডোরবেলের শব্দ হয়। খুলে দেখে রেজা। টলতে টলতে হেঁটে ঘরে ঢোকে সে।
অর্পা তার খানিক পরেই নাস্তা করে বেরিয়ে যায়।
অর্পা যাবার পর সামনের রুমে সোফায় গিয়ে বসলে তার হাঁটুতে মুখ রাখে রেজা। তার চোখের দিকে চেয়ে বলে, আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি।
শুকতারা রেজাকে বের করে দিতে পারত। চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিতে পারত। তার রাগকে সবাই ভয় পায়। শাহেদ গত এপ্রিলে আজমির গিয়ে মাজারের টাইলসের ফ্লোরে পা দিতে পারে না। গরমে পায়ের পাতা পুড়ে যায়। তাকে বলে, তোমার মেজাজের মতো গরম এখানে।
শুকতারা রেজাকে বের করে দেয় না। ঘর একা, নিরিবিলি। ফ্যানের ঘর্ঘর শব্দ। রেজা বলে, তোমার কপালে চুমু খাই?
এ সময়েই ডোর বেল বেজে ওঠে। শুকতারা ভাবে, পত্রিকার হকার কি বিলের জন্য এল? দরজা খুলে দেখে শাহেদ।
শাহেদকে দেখলে তার চোখে আলো খেলে। সে আলো আনন্দের, খুশির। আজ খেলে ভয়।
একবার কি সামনের রুমে গিয়ে রেজাকে দেখে আসবে? চায়ের কাপ নিয়ে রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়ায় সে। দরজার বাম পাশে বেসিন। সামনের রুমে না গিয়ে বেসিনের আয়নায় নিজের মুখ দেখে। মুখে কি পাপের ছায়া?
শাহেদ ব্যালকনি থেকে এসে পালঙে বসেছে। শুকতারা জিজ্ঞেস করে, তুমি কি নাস্তা খেয়েছ? পরোটা বানিয়ে দেই?
শাহেদ বলে সে নাস্তা খেয়ে বেরিয়েছে। ভোরবেলা উঠে তার হায়দ্রাবাদের কথা মনে পড়ছিল। আজমির থেকে গিয়েছিল হায়দ্রাবাদ। সেদিন সকাল থেকেই বৃষ্টি। বৃষ্টি দেখে চারমিনার আর মক্কা মসজিদ দেখার সিডিউল সকাল থেকে দুপুরের পর বদলে নিয়েছে। সকালে ব্যালকনিতে বৃষ্টি দেখতে দেখতে, বৃষ্টিভেজা নগর দেখতে দেখতে তার ইচ্ছে হচ্ছিল, ভোরের শেফালি ফুল দেখতে। তাদের ঘরের চালার উপর ছিল শেফালি ফুলগাছ। ভোরে সামনের উঠানে পড়ে থাকত কমলা বোঁটার ফুল। প্লেটে করে এনে রাখলে সুঘ্রাণে ভরে যেত ঘর।
শুকতারা বলে, রাতে ঘুম হচ্ছে না। ঘুম কেবল চোখে চোখে নাচে।
বর্ষায় ভ্যানভর্তি লটকনের মতো তার হলুদ চেহারায় যেন বিষণ্ণতা ভর করে। চোখে একবিন্দু অশ্রু ঝিলিক দেয়।
শাহেদ বলে, তোমার মনে আছে অলংকারের মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকার দিনটা?
কাঠবাদাম গাছের একপাশে রোদ, আরেক পাশে ছায়া। অপরাহ্নের ছায়ায় দাঁড়িয়ে পশ্চিমের রাস্তা দেখছে। চোখ তার রিকশায়। পরান আনন্দ অথবা অপেক্ষায় কাঁপছে। প্রতি রিকশায় খুঁজছে রুপার অলংকারের মতো চকচকে মুখ।
শুকতারা নেমে বলে, ঠান্ডা আইসক্রিম খাব।
মোড়ে মানুষের হট্টগোল, রিকশা, বাসের জটলা। শাহেদ দুজনের জন্য আইসক্রিম কেনে। আইসক্রিম খেয়ে শুকতারা বলে, চলো আমরা একটু বাজার ঘুরি।
রোদে ঘুরতে ঘুরতে খুব তৃষ্ণা পায় তাদের। টংঘরের দোকানে এসে চা খায়। চা খেতে খেতে মানুষের নিয়তির কথা বলে।
শাহেদ বলে, আমরা কত কিছু হারিয়ে হারিয়ে বালকবেলা থেকে কিশোরবেলায় পৌঁছি। একটা পয়সার থলের জন্য পেছন পেছন ঘুরি বড়ভাইয়ের। নিজের ছায়া, নিজের স্মৃতি, নিজের রোদ কত কিছু হারাতে হারাতেই কিশোর থেকে যুবক হয়ে যাই।
শুকতারা বলে, তারপর?
তারপর? অনেকদিন পর দেখা হয় সূর্যের সাথে। সূর্যের আলোয় সূর্যস্নান করি। অদ্ভুত আনন্দ হয়।
শুকতারা হেসে ওঠে। ময়না পাখির ঠোঁটের মতো হলুদাভ মুখ আরো উজ্বল হয়ে ওঠে।
শাহেদ বলে, স্নানের পর কেমন যেন শীত শীতও করে। মন ভার হয়ে ওঠে। আর এ সময়েই আসে তোমার প্রতিবেশীর মৃত্যুসংবাদ। আমরা আবার বিষণ্ণতায় ভাসি।
শুকতারা বলে, চলো আজ কোথাও বেড়াতে যাই।
শাহেদ সামনের রুমে এসে বসে। ডাক দেয়, কেমন আছ রেজা?
রেজা শোয়া থেকে উঠে পালঙে বসে। বলে, ভালো আছি।
তারপর বাথরুমে যায়। স্নান করে। শুকতারা রান্নাঘরে দুপুরের খাওয়ার আয়োজন করছে। দুপুরে খেয়ে রেজা, শাহেদ আর শুকতারা ঘর থেকে বের হয়। রেজা যায় তার অফিসের কাজে।
শাহেদ বলে, কোথায় যাবে?
শুকতারা বলে, চলো পাহাড়ের দিকে যাই।
তারা গাড়ি নিয়ে চলে আসে চন্দ্রনাথ পাহাড়ের গোড়ায়।
ব্রিজের উপর এসে গাড়ি থামে। নিচে ছোট পাহাড়ি নদী। ব্যাসকুণ্ডের পরেই নিরিবিলি পথ। দুপাশে গাবগাছ, পেয়ারার বাগান। ঝিঁঝিঁ পোকার ঝিঁঝিঁ।
গাড়ি থেকে নেমে তারা সম্ভুনাথ মন্দিরের দিকে উঠতে থাকে। বাইরে এখনো রোদ হাওয়ার সাথে লুটোপুটি খেলছে। হাওয়ায় রোদ ধীরে ধীরে ফাল্গুনে ঝরে পড়া মেহগনি পাতার মতো বাদামি হচ্ছে, বিবর্ণ হচ্ছে। ঘনিয়ে আসছে বিকেল।
উঠতে উঠতে শুকতারা ঘেমে ওঠে। তার দিকে চেয়ে শাহেদ হেসে উঠলে বলে, অনেকদিন পর পাহাড় বাইছি। ক্লান্তি লাগছে। হনুমান মন্দিরের কাছে একটা বড় তুতগাছ।
শাহেদ মোটা একটা ডাল ভেঙে নেয়।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে শুকতারার চোখে রেজার চেহারাটা ভাসে। আবার আসলে সেকি তাকে ঘর থেকে বের করে দিতে পারবে? অথবা ডোরবেল দিলে দরজা না খুলতে?
উঠতে উঠতে হনুমান মন্দির থেকে নেওয়া তুতগাছের ডালটা শুকতারাকে দেয় শাহেদ। তোমার স্কুলের সামনের ছোট মাঠে রুকো। বলে সে। যদি বেঁচে যায়, ধরে নেব আগের মতোই ভালোবাসো।
হাওয়ায় ওড়া ঘুড়ির মতো বুক কেঁপে ওঠে শুকতারা। তুতগাছ লাগালে নতুন পাতা গজাবে তো সে গাছে!
এটা কি ফুল?
হালকা বেগুনি রঙের ফুল। একটু স্মার্ট করে বললে, পার্পল রং। ছোট পার্পল রং ফুল। সম্ভুনাথ মন্দিরে উঠবার সিঁড়িতে ফুটে আছে। পাশেই ভৈরব মন্দির। মন্দিরের সামনের পাহাড়েও অনেকগুলো ফুলগাছ চোখে পড়ে। ফুলগাছে ফুল ফুটে আছে। শুকতারা বলে, রুয়েলিয়া। বুনো রুয়েলিয়া।
শাহেদ বলে, কি সুন্দর নাম! রুয়েলিয়া, রুয়েলিয়া।
[শোয়ায়েব মুহামদ
জন্ম ১ নভেম্বর, ১৯৭৬, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার মুরাদপুর। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে হিসাববিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশনে কর্মরত। প্রকাশিত বই : ঘুডিযাত্রা (গল্পগ্রন্থ, ২০১৫) নাচের পুতুল (উপন্যাস,২০২১) ফাদার ম্যানরিক ( গল্পগ্রন্থ, ২০২২)]