থিয়েটার শিল্পকলা

শাঁওলী মিত্র | শরণ ও স্মরণ | শিল্পকলা

শূন্য দিয়ে গুণ কর, সব পূর্ণ শূন্য হয়ে যায়
সেই শূন্যতাই আমি উপহার দিতে চাই তাকে।

শঙ্খ ঘোষের মৃত্যুর পরে এই লেখাটি লিখেছিলেন শাঁওলী মিত্র

তিনি চলে গেলেন। সারা জীবন বেঁধে বেঁধে থাকার প্রবল বাসনা নিয়েই অনেক অসুস্থতা সত্ত্বেও প্রবলভাবে বেঁচেছিলেন। কোথায় কী হচ্ছে, কেমন করে হচ্ছে তা জেনে নেবার সুতীব্র আকাঙ্ক্ষা। অতীব অসুস্থতা নিয়েও গত শীতে বাংলা আকাদেমিতে এসেছিলেন। এবার পাঁচজন কবিকে নিয়ে একটি প্রদর্শনী করা হয়েছিল। প্রদর্শনীর শিরোনাম ছিল ‘পাঁচটি তারার তিমির’। করোনাকালেই প্রয়াত অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, অরুণ সেন, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবেশ রায়, সুধীর চক্রবর্তীকে নিয়েই ছিল এই প্রদর্শনী। কবি আবেগভরা মন নিয়ে গগনেন্দ্র প্রদর্শশালায় দেখতে যান (৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১ )। সঙ্গে ছিলেন পরিবারের অনেকেই। অশক্ত শরীরে সেই ছিল কবির শেষ ওই সাংস্কৃতিক অঙ্গনে যাওয়া। সাজিয়েছিলেন তাঁর প্রিয় ছাত্র কবি অভীক মজুমদার। আমার অসুস্থতার কারণে আমি যেতে পারিনি। কিন্তু তিনি এসেছিলেন চাকাওয়ালা চেয়ারে বসে, মুখে মুখোশ এঁটে হলেও, তিনি এসেছিলেন। আবেগ কতো তীব্র হলে মানুষ এইভাবে ছুটে আসতে পারেন আমাদের কাজ দেখতে। যাঁদের নিয়ে প্রদর্শনী তারা তো সকলেই ওঁর বন্ধুস্থানীয়।

আমার সঙ্গে পরিচয় অনেকদিনের। নানান সময়ে কথাও হয়েছে টুকরো টুকরো। কিন্তু কখনো কাছে যেতে পারিনি। হয়তো বাধা ছিল সম্ভ্রমের। অথবা আরও কোনো ঘটনার। তবু আমাদের আন্দোলনের সময়ে, সেই চোদ্দই নভেম্বরের মিছিলে, পাশাপাশি হেঁটেছিলাম তো। হাঁটতে হাঁটতে মূর্খের মতো প্রশ্ন করেছিলাম, ‘আপনি এমন মিছিলে হেঁটেছেন?’ ওঁর হাসিমুখে সংক্ষিপ্ত উত্তর ছিল, ‘অনেক’। আমি আবার বোকার মতো বলেছিলাম, ‘আমি এই প্রথম’। উনি আবার হাসলেন। অনুমান করি আমার নির্বুদ্ধিতা ওঁকে বিরক্ত করেনি। হয়তো সেই ইসিতে করুণা ছিল।

অনেক বছর আগে বহুরূপী-র কোনো অভিনয় দেখে ভেতরে এসেছিলেন ভালোলাগা জানাতে। যাবার মুখে ফিরে জানালেন, ‘তোমার একটি লেখা আমার খুব ভালো লেগেছে।’ বিস্ময় এবং সংকোচে জিজ্ঞাসা করলাম, কোনটা?

সেবার একটি বাণিজ্যিক পত্রিকাতেও আমার একটি লেখা বেরিয়েছিল। কিন্তু না। উনি সেই লেখার কথা বলছিলেন না। আমাদের ছোট্ট বাবুল, যার ভালো নাম ছিল শুভ বসু, অভিনেতা সৌমিত্র বসুর ছোটো ভাই, ইস্কুলে পড়তে পড়তেই, ‘চেনামুখ’ বলে একটি পত্রিকা বার করেছিল। সে এসে বলত শঙ্খবাবুর কথা, নবনীতাদির কথা, এমন আরও অনেক নামীদামী মানুষের কথা—যেন তাঁরা ওরই সমবয়সী বন্ধু। এমনভাবেই কথা বলত বাবুল। আর আমি অবাক হয়ে চেয়ে থাকতুম ওর মুখের দিকে। ওর সেই পত্রিকাতে আমাকে রাজা-র সুরঙ্গনা চরিত্র নিয়ে লিখতে বলেছিল। আমি লিখেছিলাম, ‘সুরঙ্গমা : একটি পরম প্রাপ্তি’। শঙ্খবাবু সেই লেখাটির কথা বললেন। আমি অভিভূত। বাবুল নিশ্চয়ই পত্রিকাটি ওঁর হাতে পৌঁছে দিয়েছিল। দুর্ভাগ্যবশত খুবই অল্প বয়সে ও আমাদের ছেড়ে চলে যায়।

তারপরে আবার দেখা একটি আবৃত্তি অনুষ্ঠানের আয়োজনের সূত্রে। আয়োজক অন্য ব্যক্তি। কিন্তু উনি একজন অন্যতম উপদেষ্টা। মনে পড়ে আমাদের নাসিরুদ্দিন রোডের বাড়িতে এসেছিলেন। সাহিত্যিক সন্তোষ ঘোষ, শম্ভু মিত্র, হয়তো কবি অরুণ মিত্রও (ঠিক মনে নেই)। আমাকেও যেহেতু আবৃত্তি করতে হবে, তাই আমিও। আমার মা-ও বোধহয় ছিলেন আতিথেয়তায়। শেষ পর্যন্ত শঙ্খবাবু বোধহয় থাকেননি তার মধ্যে। কেন বলতে পারি না। আর অনুষ্ঠানের অভিজ্ঞতা খুব ভালো ছিল না। কার অন্ধ হস্তক্ষেপে বলতে পারি না, যেন আবিল হয়ে উঠেছিল পরিবেশ। সমবেত হওয়ার দিন এই লেখকের সঙ্গে শঙ্খবাবুর রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতার আবৃত্তির রকম নিয়ে সামান্য একটু শান্ত বিতর্ক হয়েছিল। মনে আছে তিনি চুপ করে গিয়েছিলেন। যে উত্তা আশা করেছিলাম তা পাইনি। হয়তো সেইজন্যেই আমার সংকোচ বেড়ে গিয়েছিল। বলতে পারি না।

তারপরে, যতদূর মনে পড়ে, যোগাযোগ তেমন ছিল না।

এর পরে ২০০৫-এ আমরা পঞ্চম বৈদিক থেকে চণ্ডালিকা নাটিকাটি অবলম্বনে চণ্ডালী প্রযোজনার কথা ভাবি। তখন শঙ্খবাবুর শরণাপন্ন হই। আমি যে নাট্যরূপটি তৈরি করেছিলাম সেইটি শোনাই। খুবই ভয় করছিল আমার। মনে হচ্ছিল বড্ড দুঃসাহসিক কাজে হাত দিচ্ছি। এতটা ক্ষমতা কি আমার আছে? তার আগের বছর সার্ত্র-এর ক্রাইম পাশিওনাল (রাজনৈতিক হত্যা?) করতে গিয়েও এইরকমই হাঁটু কাঁপছিল আমার। শঙ্খবাবুকে (শঙ্খদা বলবার বৃষ্টতা হয়নি কোনোদিন, সামনাসামনি। কোনোদিন সম্বোধনও করিনি।) শোনানোর পরে তাঁর অভিমত শুনে বুকে বল এল। তারপর ওই নাটক নিয়েই সম্ভবত একাধিকবার গিয়েছি। উনি একাধিকবার দেখেওছেন নাটকটি। ওঁর মতামত জেনে ত্রুটি শোধরাবার চেষ্টাও করেছি। আবার মতামত নিয়েছি। শুনেছি উনি কাউকে বলেছিলেন, “শাঁওলি নাটকটি নিয়ে খুব খেটেছে।’ এইটুকুই আমার পরম প্রাপ্তি। প্রাপ্তি এই—উনি আমাদের অনেক সময় দিয়েছিলেন।

মঞ্চশজ্জা মনে হয় ওঁর পছন্দ হয়েছিল, মা-এর মন্ত্র পড়ার দৃশ্য, মার্কিনীদের আবির্ভাব। মঞ্চসজ্জার জন্য আমরা শরণ নিয়েছিলাম রামানন্দবাবুর। শঙ্খবাবুর কিছু বক্তব্য ছিল প্রকৃতির শেষ দৃশ্যের পোশাকের রং নিয়ে। সেও আমরা বদল করেছিলাম। প্রকৃতির উত্তরণ নিয়ে অবশ্য একটা খুঁতখুঁতুনি ওঁর থেকেই গিয়েছিল। মা এবং প্রকৃতির, দুজনেরই উত্তরণের ভারসাম্য রক্ষা করার ব্যাপারে একরকম সংশয় থেকেই যাচ্ছিল। সেখানেই ওঁর অতৃপ্তিও থেকে গিয়েছিল। অনেক ভেবেও সেই সংশয়ের উপশম ঘটাতে পারিনি।

এরপরে আমাদের বঙ্গে শুরু হল আলোড়ন। শঙ্খবাবুও তাঁর মতো করেই তার প্রতিবাদের শামিল হলেন। আর একটি ক্ষেত্রে ওঁর ব্যবহার আমাকে ওঁর কাছে চিরদিন কৃতজ্ঞ করে রাখবে। উনি শম্ভু মিত্র-র একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। সেদিন নাকি শম্ভু মিত্র অনেক অনেক কথা বলেছিলেন, অনেকক্ষণ ধরে। সেটি ফিতে বন্ধ করা হয়েছিল। যাঁদের উদ্যোগে ঘটনাটি ঘটেছিল তাঁরা তার পরে তা নিয়ে কিছু করেনি। অনেক পরে শঙ্খবাবুর কাছে সেই ফিতে এসেছিল। উনি আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন তার সবটাই প্রকাশযোগ্য কিনা তা জানবার জন্যে। আমার যন্ত্রে তার থেকে কোনো আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল না। তখন শঙ্খবাবুই উদ্যোগ নিয়ে ওই সাক্ষাৎকার থেকে, বা বলা যায় সেদিনের বক্তব্য, সাজিয়ে এক বক্তার বৈঠক গ্রন্থটি প্রকাশ করেন। সে যে কী ভালো একটি বই যাঁরা তাঁকে জানতেন তাঁরা নিশ্চয়ই অনুভব করেছেন। শম্ভু মিত্র-র কথা বলবার একরকম ধরণ ছিল। সেই ধরণটি পুরো বজায় রাখা হয়েছিল ওই লিখিত রূপটিতে। বইটির খুব চাহিদা ছিল। একদিন একটি খামে বেশ কিছু টাকা আমার কাছে পৌঁছল। শঙ্খবাবু পাঠিয়েছেন। ওই বইটি থেকে যা প্রাপ্ত হয়েছিল। সবই নাকি আমার প্রাপ্য। আমি খুবই আপত্তি করলুম। ‘এ কী! আমি কেন? আমি তো ওর মধ্যে কোথাও নেই। আমার তো জানাই ছিল না ঘটনাটি।’ উনি ওঁর মতো করেই জোর করেন। এর টাকা নাকি আমারই প্রাপ্য। আমাকে নিতে হল সেই রয়্যালটির টাকা। যখনই ওই কথা স্মরণ করি আমার যেন চোখে জল আসে।

কিছু দিন আগে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জন্মদিন উপলক্ষ্যে গোর্কি সদনের অনুষ্ঠানে দেখা। পাশে বসিয়ে কত কথা বললেন। অবশ্য আমিই বললুম বেশি। উনি শুনলেন। এই উপলক্ষ্যে বাংলা আকাদেমিতেও আমাদের প্রদর্শনী হয়েছিল। শুনলাম উনি আগেই ওটি দেখে এসেছেন এবং ভীষণ খুশি হয়েছেন। সেই খুশি মুখটি ভুলতে পারি না। আমার হাড় ভেঙেছে শুনে খুবই বিচলিত হয়েছিলেন সেদিন।

তার আগেই বোধহয় একবার শ্রীযুক্ত শিবনারায়ণ রায় স্মরণে একটি বক্তব্য পেশ করতে হয়েছিল নাটকের উচ্চারণ ভঙ্গি নিয়ে। শঙ্খবাবু শ্রোতার আসনে। আরও অনেক গুণীজন। ভয় করছিল খুব। তবু বলতে তো হবেই। সেই বক্তব্য শুনে শঙ্খবাবু বলেছিলেন, ‘ভালো। মানে খুবই ভালো।’

এই স্বল্পভাষী মানুষটির কাছ থেকে পাওয়া এই ছোটো ছোটো বাক্যগুলি আমার কাছে আশীর্বাদস্বরূপ। কাছে যেতে পারিনি। নৈকট্যের চেয়ে দূরত্বই ছিল বেশি। সমীহ ছিল অপরিমেয়। কিন্তু এই ছোটো ছোটো ভালোলাগার প্রকাশই আমার কাছে অমনিই অপরিমেয় আশীর্বাদ।

শাঁওলী মিত্র
পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির সভাপতি। পঞ্চম বৈদিক-এর প্রধান। অভিনেত্রী। অভিনীত নাটক পাগলা ঘোড়া, রাজা, নাথবতী অনাথবৎ… কথা অমৃত সমান, পশুখামার। প্রকাশিত কয়েকটি গ্রন্থ : চিন্তা, দিদৃক্ষা, মুকুরে মুখ না মুখোশ, শম্ভু মিত্র, বিচিত্র জীবন পরিক্রমা, ধ্যানে ও অন্তর্ধানে।

ঋণ : নান্দীপট

    Leave feedback about this

    • Rating

    PROS

    +
    Add Field

    CONS

    +
    Add Field