বাংলা কথাসাহিত্যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ এক অবিস্মরণীয় নাম। বাংলা সাহিত্যের বৃহত্তর পরিসরে তিনি কোনো যুগান্তর ঘটাননি। তবে র্যা ডক্লিফ অঙ্কিত পূর্ববাংলার সাহিত্যিক মানচিত্রে তাঁর ভূমিকা যুগপ্রবর্তকের। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে এই ভূখণ্ডের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী, আধা-সামন্ত বাঁধনে আবদ্ধ গ্রামীণ মুসলমান সমাজের জীবনযাত্রা উপস্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস লিখেছেন আবুল ফজল, আবু জাফর শামসুদ্দীন, শওকত ওসমান, শহীদুল্লা কায়সার, আবু ইসহাকের মতো কৃতী ঔপন্যাসিকগণ। এরপরও কোথায় যেন শূন্যতা ছিল – আধুনিক কথাসাহিত্যের প্রকরণে সমৃদ্ধ কিংবা শক্তিশালী কোনো ঔপন্যাসিকের তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন লেখার জন্য প্রতীক্ষা। এই দুই ঘাটতি পূরণ হলো সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘লালসালু’ উপন্যাস প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে। এই ভূখণ্ডের কথাসাহিত্যে পালাবদলের রূপকার ও আধুনিকতার প্রবর্তক হওয়ার গৌরবে স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত হয়ে রইল ‘লালসালু’। এই উপন্যাস সম্পর্কে লক্ষ্যভেদী মন্তব্য করেছেন হাসান আজিজুল হক তাঁর ‘কথাসাহিত্যের কথকতা’ বইতে :
‘…বাংলাদেশের উপন্যাসে কীভাবে অচেতন প্রয়াসের ক্লান্তিকর অনুবর্তনের মধ্যে প্রথম সচেতন শিল্পীর পদপাত ঘটে তা বুঝতে গেলে আমাদের সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর রচনার সঙ্গে পরিচিতি হতে হবে। জীবননিষ্ঠা ও আধুনিক শিল্পপ্রকরণ, তীব্র শৈল্পিক সচেতনতা ও দক্ষতা, স্নায়ু-ছেঁড়া সংযম ও পরিমিতিবোধ, নিচু ও নির্বিকার উচ্চারণ – আধুনিক সুনির্মিত উপন্যাসের সব বৈশিষ্ট্য সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহতে পাওয়া যায়। ‘লালসালু’ উপন্যাস প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের উপন্যাস আধুনিক কথাসাহিত্যে প্রবেশ করে।’
১৯৪৮ সালে প্রকাশলগ্ন থেকেই ‘লালসালু’র আধুনিকতা সাহিত্যবোদ্ধাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কাফকা, জয়েস, কামুর মতো পশ্চিমা সাহিত্যিকের প্রভাব ওয়ালীউল্লাহর লেখায় স্পষ্ট। নব্য ফ্রয়েডীয় মনোবিশ্লেষণও তাকে প্রভাবিত করেছে। এই বৈশিষ্ট্য আধুনিকতার এক পিঠ। অন্য পিঠে রয়েছে পাভলভীয় মনস্তত্ত্বের অন্তঃসার যা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। ওয়ালীউল্লাহ প্রথমোক্ত ধারার আধুনিক, অন্তত ‘লালসালু’ উপন্যাসে। তাঁর ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গি ফ্রয়েডীয় মনস্তত্ত্ব-জারিত আধুনিকতাকে এদেশের কথাসাহিত্যে প্রতিষ্ঠা দান করে এই উপন্যাসের মাধ্যমে।
‘লালসালু’ যখন প্রকাশিত হয়, দ্বিজাতিতত্ত্বের ফসল নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তান তখন সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় রাজনীতির মৌতাতে আচ্ছন্ন। সেই সময় ধর্মান্ধতা তথা ধর্মকেন্দ্রিক অপরাজনীতির মুখোশ উন্মোচন করার জন্য যে শিল্পিত স্পর্ধা প্রয়োজন ছিল তারই সার্থক প্রয়োগ ঘটিয়েছেন ওয়ালীউল্লাহ এই উপন্যাসে। ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’ গড়ে তোলার মাধ্যমে ওয়ালীউল্লাহর পূর্বসূরীগণ বাঙালি মুসলমানের মানসমুক্তির জন্য যে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিলেন, ‘লালসালু’ সেই সংগ্রামেরই ধারাবাহিকতা। এক্ষেত্রে তিনি কত বড় ঝুঁকি নিয়েছিলেন তা লক্ষ করেছেন শিবনারায়ণ রায়। ‘রবীন্দ্রনাথ, শেক্সপীয়র ও নক্ষত্রসংকেত’ বইতে তিনি বলেছেন :
‘জীবনের অনিশ্চয়তাজনিত ভয় এবং অলৌকিক বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে বিত্তসম্বলহীন কিন্তু অভিনয়দক্ষ ও চতুর উদ্যোগীজন যে কিভাবে প্রতিষ্ঠা অর্জন করে, খোদার কালাম যে তার ব্যবসায়ে কত বড় পুঁজি হয়ে উঠতে পারে, বাঙালি ঔপন্যাসিকদের মধ্যে ওয়ালীউল্লাহর আগে আর কেউ কাহিনীর ভিতর দিয়ে এত অনাবিদ্ধ দুঃসাহসে সেটি ফুটিয়ে তুলেছেন বলে আমার অন্তত জানা নেই। হিন্দু সাধুবাবা এবং ধর্মীয় আশ্রম প্রতিষ্ঠানের ভিতরকার চেহারা নিয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য লিখেছিলেন, কিন্তু ‘অহিংসা’ উপন্যাসের (১৯৪১) উৎকর্ষ লক্ষ করার পরও আমার মনে হয় ‘লালসালু’র ধীপ্রদীপ্ত, অনন্যতন্ত্র সাহসিকতার তুলনা সেখানেও মেলে না। আসলে হিন্দু আশ্রম গুরুদের চরিত্র বিশ্লেষণের চাইতে মুসলিম পীর মোল্লাদের চরিত্র বিশ্লেষণ যে-কোনো বাঙালি লেখকের পক্ষে বেশি বিপজ্জনক।’
এই বিপজ্জনক কাজটি ওয়ালীউল্লাহর উত্তরসূরি ঔপন্যাসিকগণও করেছেন। কিন্তু ‘লালসালু’র মতো শৈল্পিক সাফল্য অন্য কোনো সাহিত্যকর্ম অর্জন করতে পারেনি। উদাহরণ দেয়া যায় হুমায়ুন আজাদের ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ থেকে। এ উপন্যাসে ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদের ভণ্ডামিকে তিনি যেমন নগ্নভাবে উপস্থাপন করেছেন তা অভূতপূর্ব। এ কারণে লেখকের জীবন পর্যন্ত বিপন্ন হয়েছে। তবে এ উপন্যাসটি যথার্থ শিল্পকর্ম হয়ে উঠতে পারেনি। এখানেই ‘লালসালু’র শ্রেষ্ঠত্ব। ‘পাকসার জমিন সাদ বাদ’-এর তুলনায় নিরীহ উপন্যাস ‘লালসালু’। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ভোঁতা চৈতন্যে এই ক্ষুরধার উপন্যাসটি কোনো আঁচড় কাটতে পারেনি। কিন্তু চরিত্র চিত্রণে, ডিটেলস রূপায়ণে, পরিবেশ, আবহ ও চিত্রকল্প রচনায় ‘লালসালু’ তৎকালীন ধর্মতন্ত্রী রাজনীতির বিরুদ্ধে এক শানিত ও শৈল্পিক প্রতিবাদ। উপন্যাসের শুরুতেই মহব্বতনগর গ্রামের পরিবেশ উপস্থাপনে লেখকের সংস্কারমুক্ত ও সাহসী দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায় :
‘…শস্য নেই। যা আছে তা যৎসামান্য। শস্যের চেয়ে টুপি বেশি, ধর্মের আগাছা বেশি। ভোরবেলায় মক্তবে এত আর্তনাদ ওঠে যে, মনে হয় এটা খোদাতা’লার বিশেষ দেশ। ন্যাংটা ছেলেও আমসিপারা পড়ে, গলা ফাটিয়ে মৌলবীর বয়স্ক গলাকে ডুবিয়ে সমস্বরে চেঁচিয়ে পড়ে। গোঁফ উঠতে না উঠতেই কোরান হেফ্জ করা সারা। সঙ্গে সঙ্গে মুখেও কেমন একটা ভাব জাগে। হাফেজ তারা। বেহেশতে তাদের স্থান নির্দিষ্ট।’
‘লালসালু’ উপন্যাস ওয়ালীউল্লাহর দৃষ্টিভঙ্গি সামাজিক নৃতত্ত্ববিদের। লেখকের অন্তর্ভেদী পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা উপন্যাসের বহির্বাস্তব চিত্র রচনায় যেমন পারঙ্গমতা দেখিয়েছে তেমনি চরিত্র ও চিত্রকল্প নির্মাণেও শিল্প-কুশলতার স্বাক্ষর রেখেছে। মহব্বতনগর গ্রামে মজিদের আগমনের সময় তাহের-কাদেরের কোঁচ দিয়ে মাছ মারার দৃশ্যটি অনবদ্য। এখানে ডিটেলসের কাজ চলচ্চিত্রের দৃশ্যের সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে। লেখকের অসাধারণ ভাষাশৈলীতে ভিজ্যুয়ালাইজেশন ঘটেছে সমগ্র প্রেক্ষাপটের :
‘… একটু বাঁয়ে ক-টা শিষ নড়ছে – নিরাকপড়া বিস্তৃত ধানক্ষেতে কেমন স্পষ্ট দেখায় সে-নড়া। আরো বাঁয়ে। সাবধান, আস্তে। তাহেরের আঙুল অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় এসব নির্দেশই দেয়।
ততক্ষণে সে পাশ থেকে আলগোছে কোঁচটা তুলে নিয়েছে। নিতে একটুও শব্দ হয়নি। হয় নি তার প্রমাণ, ধানের শীষ এখনো ওখানে নড়ছে। তারপর কয়েকটা নিঃশ্বাসরুদ্ধ করা মুহূর্ত। দূরে যে-কটা নৌকা ধান ক্ষেতের ফাঁকে ফাঁকে এমনি নিঃশব্দে ভাসছিল, সেগুলো থেমে যায়। লোকেরা স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ধনুকের মতো টান-হয়ে-ওঠা তাহেরের কালো দেহটির পানে। তারপর দেখে, হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মতো সেই কালো দেহের ঊর্ধ্বাংশ কেঁপে উঠলো, তীরের মতো বেরিয়ে গেল একটা কোঁচ। সা-ঝাক্।
একটু পরে একটা বৃহৎ রুই মুখ হা-করে ভেসে ওঠে।’
নাটকীয়ভাবে মহব্বতনগর গ্রামে প্রবেশ ঘটে মজিদের। ‘দুনিয়ায় স্বচ্ছলভাবে দুবেলা খেয়ে বাঁচবার জন্য’ সাংঘাতিক খেলার আশ্রয় নেয় সে। গ্রামের বাঁশঝাড়ের পাশে পুরনো এক জীর্ণ কবরকে অবলম্বন করে বিপজ্জনক খেলায় মেতে ওঠে মজিদ। এই কবরকে ‘মোদাচ্ছের পীরের মাজার’ হিসেবে চিহ্নিত করে কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন দেয় মজিদ। দরিদ্র, অজ্ঞ গ্রামবাসী মুহূর্তের মধ্যেই লজ্জিত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। গ্রামের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি খালেক ব্যাপারী তার দোসর জুটে যায়। খালেকের আর্থিক প্রতিপত্তি আর মজিদের ধর্মীয় নেতার মুখোশ পরস্পরকে একই গন্তব্যে ঠেলে দেয় – ‘একজনের আছে মাজার আরেকজনের জমিজোত প্রতিপত্তি। সজ্ঞানে না জানলেও তারা একাট্টা, পথ তাদের এক।’
‘মোদাচ্ছের পীরের মাজার’ ঝকঝকে তকতকে হয়ে ওঠে। লালসালু বিছানো হয় উজ্জ্বল মাজারে। মজিদেরও বাহ্যিক উজ্জ্বলতা বাড়ে। জমি, ঘর-বাড়ি, স্ত্রী জুটে যায় চোখের নিমেষে। স্ত্রী রহিমার বাহ্যিক গড়ন আকৃষ্ট করেছিল মজিদকে। দীর্ঘ গড়নের রহীমা ভেতরে ভেতরে অত্যন্ত ভীতু। শীর্ণকায় মজিদের ‘পেছনে মাছের পিঠের মতো মাজারটির বৃহৎ ছায়া’ তাকে মজিদের প্রতি সন্ত্রস্ত করে তোলে। মাজারটিকে শক্তির উৎস হিসেবে ব্যবহার করার মাধ্যমে মজিদ গ্রামের একচ্ছত্র অধিপতি বনে যায়। বয়স্ক মানুষদের ধমকে কলেমা পড়ায়, খোদার নাম ব্যবহার করে এক বৃদ্ধকে এমনভাবে নাস্তানাবুদ করে যে সে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়। পিতা-পুত্রকে জোর করে প্রকাশ্যে বাজারে খৎনা দেয়। মজিদের স্বেচ্ছাচারিতা গ্রামবাসী মুখ বুঁজে সহ্য করে কারণ :
‘গ্রামের লোকেরা যেন রহিমারই অন্য সংস্করণ। তাগড়া-তাগড়া দেহ – চেনে জমি আর ধান, চেনে পেট। খোদার কথা নেই। স্মরণ করিয়ে দিলে আছে, নচেৎ ভুল মেরে থাকে। জমির জন্যে প্রাণ। সে-জমিতে বর্ষণহীন খরার দিনে ফাটল ধরলে তখন কেবল স্মরণ হয় খোদাকে।’
প্রায় অপ্রতিরোধ্য গতিতে মজিদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে মহব্বতনগর গ্রামে। মজিদের একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রথমবারের মতো প্রশ্নবিদ্ধ হয় অন্য গ্রাম থেকে এক পীরের আগমনের ফলে। গ্রামের লোকজন তার প্রতি আকৃষ্ট হওয়াতে ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে মজিদ। নিজে ভণ্ড বলে সেই পীরের ভণ্ডামি সম্পর্কে মজিদ সচেতন। তাই সেই পীরকে ধরাশায়ী করার চেষ্টা করে। তার কিছু অনুসারী এই পীরের সভায় হামলা করে। তেমন লাভ হয় না। আক্রমণকারীরাই আক্রান্ত হয়, তাদের মাথা ফাটে, হাসপাতালে যেতে হয়। তবে সেই পীরও গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হয়। খালেক ব্যাপারীর নিঃসন্তান স্ত্রী আমেনা বিবি সন্তান কামনায় সেই পীরের পানিপড়া খেতে চায়। প্রতিহিংসাপরায়ণ মজিদ নিষ্ঠুর ও নাটকীয় পন্থায় খালেক ব্যাপারীকে বাধ্য করে আমেনা বিবিকে তালাক দিতে। নিরপরাধ ও স্বল্পভাষী আমেনা বিবির চিরবিদায় ঘটে মহব্বতনগর থেকে। বিদেশ প্রত্যাগত মুক্তমনা যুবক আক্কাস গ্রামে একটি স্কুল স্থাপনের উদ্যোগ নেয়ায় আঁতকে ওঠে মজিদ। তার আধিপত্যের প্রধান উৎস গ্রামবাসীর অজ্ঞতা। স্কুল প্রতিষ্ঠার পরিণাম তার চেয়ে ভাল আর কে জানে? তড়িঘড়ি উদ্যোগ নিয়ে সে আক্কাসকে সবার সামনে অপদস্থ করে। স্কুল স্থাপন না হলেও মসজিদ স্থাপনের ঘোষণা দেয় মজিদ। এই ঘোষণার সঙ্গে একাত্ম না হওয়ার কোনো কারণ ছিল না গ্রামবাসীর।
যে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা মজিদকে গ্রামের সবচেয়ে কর্তৃত্বশালী ব্যক্তিতে পরিণত করে সেই ক্ষমতাই তার মধ্যে জন্ম দেয় গভীর নৈঃসঙ্গ্যবোধের। তার সমৃদ্ধি ও যশের মূলে যে মাজার সেই মাজারের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে সে। কার কবরকে পুঁজি করে ব্যবসা করছে নিজেকেই সে প্রশ্ন করে মজিদ। যে কবর তার সাফল্যের উৎস সেই কবর তার মনকে ভীত ও নিঃসঙ্গ করে তোলে। এই নিঃসঙ্গতা কালের মতো আদিঅন্তহীন।
চরম নিঃসঙ্গতা থেকে মজিদের মনে হয় যে সে জীবনকে উপভোগ করতে পারেনি। শীর্ণকায় মজিদকে অতৃপ্তিজনিত হতাশা গ্রাস করে। রহিমার শারীরিক গড়ন তাকে আকৃষ্ট করেছিল, কিন্তু শয্যায় মজিদের শরীরে সে কোনো উত্তাপ তৈরি করতে পারে না। অথচ হাসুনির মায়ের ‘নগ্ন বাহু-পিঠ-কাঁধ’ আর আমেনা বিবির ‘সাদা মসৃণ পা’ অন্তহীন কামানল তৈরি করে মজিদের ভেতর। নিজের অক্ষম যৌন আবেগকে সংযত করতেই সে আবার বিয়ে করে। তার নতুন স্ত্রী জমিলা।
জমিলা চরিত্রটি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর অবিস্মরণীয় সৃষ্টি। পরবর্তী দুটি উপন্যাসেও লেখক ধর্মীয় অনাচার, কুসংস্কার ও সামাজিক অসঙ্গতিকে উপস্থাপন করেছেন। তবে আপাদমস্তক দ্রোহে উজ্জ্বল কোনো চরিত্র নির্মাণ করেননি। জমিলা তাই ‘লালসালু’ উপন্যাসে এক ব্যতিক্রমী সৃজন। কিশোরী জমিলা উপন্যাসে তার আবির্ভাব লগ্ন থেকেই বিদ্রোহী। মজিদের একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে একমাত্র সেই হয়ে দাঁড়ায় বাধার প্রাচীর। সে জোরে শব্দ করে হাসে, মজিদের হুমকিকে অগ্রাহ্য করে নামাজ পড়তে ভুলে যায়। ঘোমটা ছাড়াই বাড়ির বাইরে চলে যায় সমবেত জনতার সামনে। মজিদ তার মনে আতঙ্ক সৃষ্টির ব্যর্থ চেষ্টা করে। কিছুতেই বিচলিত হয় না জমিলা, সে জায়নামাজে ঘুমিয়ে পড়ে। ক্রুদ্ধ মজিদ তাকে জোর করে মাজারে নিয়ে যেতে চায়। জমিলা নিজেকে মুক্ত করতে ব্যর্থ হয়ে মজিদের মুখে থুথু নিক্ষেপ করে। কাপুরুষ গ্রামবাসীর মধ্য থেকে এই প্রথম পৌরুষের ঝলক হয়ে উঠলো জমিলার থুথু। ‘যার কথায় গ্রাম ওঠে-বসে, যার নির্দেশে খালেক ব্যাপারীর মতো প্রতিপত্তিশালী লোকও বউ তালাক দেয় দ্বিরুক্তি মাত্র না করে, যার পা খোদাভক্ত লোকেরা চুম্বনে-চুম্বনে সিক্ত করে দেয়, তার প্রতি এমন চরম অশ্রদ্ধা’ প্রদর্শনের সাহস এই প্রথম কেউ দেখাল। যে সমাজকে নিংড়ে ওয়ালীউল্লাহ ‘লালসালু’ লিখেছেন সেই সমাজে ধর্মতন্ত্র ও পুরুষতন্ত্র সমার্থক। তাই মজিদের নিরঙ্কুশ ক্ষমতাকে অগ্রাহ্য করার দুঃসাহস যে একটি নারী চরিত্র করেছে এর তাৎপর্য অসামান্য।
উপন্যাসের এই অংশে জমিলার দ্রোহের চিত্র অঙ্কনের সময় লেখক অসাধারণ কৌতুক রসের পরিচয় দিয়েছেন। জমিলাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে পাঁজাকোলা করে মজিদ বাইরে যায় মাজারের উদ্দেশে। ক্ষুব্ধ মজিদের মন ও শরীর দুই-ই রূঢ়। এই রূঢ়তা পলকের জন্য বিলীন হয়ে যায় জমিলার কোমল দেহস্পর্শে :
‘….এত নরম তার দেহের ঘনিষ্ঠতা যে তারার ঝলকানির মতো এক মুহূর্তের জন্য মজিদের মনে ঝলকে ওঠে একটা আকুলতা; তা তাকে তার বুকের মধ্যে ফুলের মতো নিষ্পেষিত করে ফেলবার। কিন্তু সে ক্ষুদ্র লতার মতো মেয়েটির প্রতিই ভয়টা দুর্দান্ত হয়ে উঠল।’
এমন কৌতুকময় দৃশ্য আরো রয়েছে ‘লালসালু’ উপন্যাসে। লেখক শুরুতেই বলেছেন যাত্রীদের হুড়োহুড়ি করে গাড়িতে ওঠার সময়, ‘কারো বদনাটা – যা না হলে বিদেশে এক পা চলে না কি করে আলগোছে হারিয়ে যায়।’ রেলগাড়ির এ ভিড়ে ‘অনেকের অনেক সময় গলায় ঝোলানো তাবিজের থোকাটা ছাড়া দেহে বিন্দুমাত্র বস্তু থাকে না শেষ পর্যন্ত। তারা অবশ্য বয়সে ছোকরা বয়স হলে এরা আর কিছু না হোক শক্ত করে গিরেটা দিতে শেখে।’ লালসালু আচ্ছাদিত মাজারে ভিড় জমে যায় পুণ্যপ্রত্যাশীদের। তারা নিয়ে আসে ‘ঝকঝকে পয়সা, ঘষা পয়সা, সিকি-দুআনি-আধুলি, সাচ্চা টাকা, নকল টাকা।’ পীর সাহেবদের ঋতুভিত্তিক ব্যবসা প্রসঙ্গে লেখকের বক্তব্য, ‘যেবার আকাল পড়ে সেবার অতিভক্ত মুরিদের ঘরেও দু’দিন গা ঢেলে থাকতে ভরসা হয় না পীর সাহেবের।’ অসাধারণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ও আধুনিক মানসের অধিকারী হওয়া ছাড়া কৌতুকরসে এসব মর্মান্তিক ঘটনা জারিত করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রেও ওয়ালীউল্লাহর বিশেষত্বের পরিচয় পাওয়া যায়।
অবশেষে জমিলাকে শক্ত হাতে ধরে মাজারে পৌঁছতে সমর্থ হয় মজিদ। মজিদ আত্মবিশ্বাসী যে গভীর রাতে মাজারে থাকলে জমিলা ভয় পাবে, তার বশ্যতা স্বীকার করবে। একটি খুঁটির সঙ্গে দড়ি দিয়ে জমিলার কোমর বেঁধে মাজার ঘরের ঝাঁপি বন্ধ করে মজিদ চলে আসে। বাড়ি ফিরে তার অস্থির অপেক্ষা জমিলার আর্তনাদ শোনার জন্য। রাতে প্রবল ঝড় শুরু হয়, সেই সঙ্গে শিলাবৃষ্টি। বাইরে প্রকৃতির এই রুদ্র রূপ, এর সমান্তরালে মজিদের সংসারেও এতদিনের আনুগত্য ধ্বংসের মুখোমুখি। জমিলার বিদ্রোহ প্রাণ সঞ্চার করে রহিমার অর্ধ-চেতন হৃদয়েও। মজিদের প্রতি ‘যার আনুগত্য ধ্রুবতারার মতো অনড়’ সেই রহীমা স্পষ্ট ভাষায় মজিদকে বলে, ‘ধান দিয়া কী হইব মানুষের জান যদি না থাকে? আপনে ওরে নিয়া আসেন ভিতরে।’ ভীতু রহিমার কণ্ঠে এই প্রথম শোনা গেল প্রতিবাদের ভাষা।
রহীমার আদেশ অগ্রাহ্য করতে পারে না মজিদ। মাজারের ঝাঁপি খুলে সে আবিষ্কার করে লাল কাপড়ে আবৃত কবরের পাশে চিৎ হয়ে পড়ে আছে অর্ধনগ্ন জমিলা ‘আর মেহেদি দেয়া তার একটা পা কবরের গায়ের সঙ্গে লেগে আছে।’ এই পদাঘাত শুধু কবরের গায়ে নয়, মজিদের প্রতিপত্তির উৎস নকল মাজারের প্রতিই নয়; সমস্ত গ্রামের মাথা মজিদকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যানেরও প্রতীক। ঘটনার আকস্মিকতায় মজিদ বিমূঢ়। ঘরে শুধু নয়, বাইরেও তার কর্তৃত্ব প্রশ্নের সম্মুখীন। ঝড়ে লণ্ডভণ্ড আবাদি ফসল দেখে মুষড়ে পড়া কৃষকরা মজিদের কাছে এর প্রতিকার চায়। মজিদ তার পুরনো ও মরচে ধরা অস্ত্রই ব্যবহার করে। কঠিনস্বরে গ্রামবাসীকে বলে, ‘…নাফরমানি করিও না। খোদার উপর তোয়াক্কল রাখো।’ এই উপদেশ গ্রামবাসীকে শোনালেও আসলে কি নিজেকেই দিচ্ছে না মজিদ? ক্ষমতা ও নৈঃসঙ্গ্যের শীর্ষবিন্দুতে অবস্থানরত মজিদ উপলব্ধি করে আসন্ন পতন রোধের জন্য ‘খোদার উপর তোয়াক্কল’ই তার একমাত্র ভরসা।
উপন্যাসটি আক্ষরিক অর্থেই কালোত্তীর্ণ। ‘লালসালু’কে একবিংশ শতাব্দীর প্রেক্ষাপটে অনায়াসে দাঁড় করিয়ে দেওয়া যায়। সমাজদেহে ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার এবং মুক্তচিন্তা, উদারতা ও বিজ্ঞানমনস্কতার ক্ষয়িষ্ণু ধারা এই উপন্যাসকে সমকালীনতা দান করেছে। ওয়ালীউল্লাহ ধর্মবিশ্বাসকে আক্রমণ করেননি, আক্রমণ করেছেন ধর্মব্যবসা ও ধর্মের নামে প্রচলিত অমানবিকতাকে। উপন্যাসের লালসালু শুধু অজ্ঞাত পীরের কবরকে আবৃত করেনি, আবৃত করেছে মানুষের বিবেকবুদ্ধিকেও। কুসংস্কার ও ভণ্ডামির সেই আবরণকে শৈল্পিক নৈপুণ্যে উন্মোচন করেছেন ঔপন্যাসিক।
শুধু শৈল্পিক সাফল্যে নয়, প্রায়োগিক মূল্যেও ‘লালসালু’ বাংলা সাহিত্যে এক অনন্য সৃজন। যে আধুনিক মেজাজ ও সংস্কারমুক্ত দৃষ্টি এই উপন্যাসটিকে ওয়ালীউল্লাহর সবচেয়ে দৃষ্টিগ্রাহ্য সাহিত্যকর্মে পরিণত করেছিল তার উৎস লেখকের শিল্পিত স্পর্ধা। ধর্মমোহে আচ্ছন্ন, একটি রক্ষণশীল ‘আধমরা’ জনগোষ্ঠীকে ‘ঘা মেরে জাগানোর’ কাজটি নিপুণ হাতে করেছেন ওয়ালীউল্লাহ। শুধু একারণেই ‘লালসালু’র আসন বাংলা সাহিত্যে চিরস্থায়ী হতে পারে।
Leave feedback about this