এসো সখী নিরজনে
বেশকিছু দিন হলো, আমরা মেসেঞ্জারে একটা গ্রুপ খুলেছি। গ্রুপের নাম ‘এসো সখী নিরজনে’। তৃষ্ণা, নাসরীন, সুজাতা, কেয়া আরো কতকত প্রিয় নাম, প্রিয়তমা মুখ! তেইশ বছর আগে যাদের স্মৃতি ফেলে এসেছিলাম কলেজের করিডোর, ক্লাসরুম, চটপটির প্লেট অথবা কামিনী ফুলের ঘ্রাণে। রাত নেই, দিন নেই, ‘কোথায় আছিস? কি করিস? ছেলেমেয়ে কজন? তারা কি করে?’ ইত্যাকার গল্পে চারকোনা এজমালি বক্সে সময়গুলো যেন নানা ঢঙে রঙ খেলে, ছবি আঁকে, তুলো তুলো মেঘ হয়ে ভেসে যায়, ভাসায়। সকলেই ভুলে যায়, বয়সের মিড পয়েন্টের সর্বনাম!
হুট করে ইরা ভিডিও কল করে। আমি, বাঁধন, হাসি, হাস্না, কেয়া, নির্ঝরা জয়েন করি।
‘এই চল না! একটা গেট টুগেদার করি। কলেজের পুকুরপাড়ে বকুলতলায় গোল হয়ে বসব অথবা শান বাঁধানো সেই গাছের গোড়ায়। মনে আছে আমরা ওখানটাতে বসে চটপটি খেতাম? মোস্তফা মামার মতো চটপটি পুরো ঢাকা শহরের কেউ বানাতে পারতো না।’ ইরা একা একাই বলে যাচ্ছে। ‘কেউ কিছু বলছিস না যে! চল না, দেখা হোক আমাদের। কলেজটাও দেখে আসি। সেই বেরিয়ে এসেছি আর ঢুকিনি। কত বছর বলতো?’ আমরা সকলে চুপ! নিঃসাড়। যেন গভীর নিস্তরঙ্গে ডুবে গেছে সময়। আজকের মধ্যবয়সী কজন নারী নিজেদের কুসুমমুখটা কল্পনা করছে হয়তবা, অথবা অনুভব করছে আদুরে সেসব দিনের স্পর্শ। আবার বর্তমানে এসে খেই হারিয়ে ফেলছে, এত এত কাজের ভিড়ে সময় কোথায় পাই? অগত্যা মিরা প্রসঙ্গ বদলে দেয়। কথার খই ফোটে, ছুটে চলে স্মৃতির মিনার…
কিন্তু নির্ঝরা একদম চুপ! বিষণ্ণতার মূর্ত প্রতীক যেন! কি হয়েছে ওর? আমি এজমালি বক্স থেকে বেরিয়ে ওর পার্সোনাল বক্সে টোকা দেই, ‘নির্ঝরা ভালো আছিস তো!’
‘হুম। তুই?’
‘আমি তো অলটাইম বিন্দাস। কিন্তু তোর কী হয়েছে সত্যি করে বলত?’
নির্ঝরা জবাব দেয় না। ওর সবুজ বাতিটাও টুপ করে নিভে যায়।
গভীর রাতে নির্ঝরা লেখে, ‘অন্তরা, জেগে আছিস?’
আমি ছোট্ট করে জবাব দেই, ‘হুম।’
‘ফোন করব ?’
‘কর।’
ভিডিও কল। স্ক্রিণে বুড়োটে শুকনো পদ্মপাতা মুখ। গভীর কালো চোখজোড়া পানিতে উপচে পড়ছে।
‘কি হয়েছে নির্ঝরা?’
‘ আর পারছিনে। একা খুব কষ্ট হয় রে।’
‘একা কেন? তোর বর কই?’
‘ওর আরেকটা সংসার আছে।’
‘কী বলছিস? ছেলে?’
‘ওরও সংসার হয়েছে, বিদেশে থাকে।’
‘মেয়ে কোথায়।?
‘সে তো স্বামী সংসার নিয়ে দূরের শহরে।’
আমি চুপ। নির্ঝরাও। খানিকটা পরে ওর নামের পাশে সবুজ বাতি নিভে যায়। আহা, নির্ঝরা কী বলি তোকে। আমিও যে…
আমি, নির্ঝরা এজমালি বক্সে সবার সাথে আবারো মেতে উঠি। কে জানে তৃষ্ণা, পপি, আইরিন, কেয়া সবার হাসিমুখের অন্তরালে হয়ত একই গানের সুর বাজে…।
‘দিনেকের দেখা, তিলেকের সুখ,
ক্ষণেকের তরে শুধু হাসিমুখ–
পলকের পরে থাকে বুক ভ’রে চিরজনমের বেদনা।’
পেছনের গল্প
অনেকের কাছে লেখক হওয়া একটি স্বপ্ন। কিন্তু কেউ ইচ্ছে করলেই লেখক হতে পারেন না। তার মধ্যে সৃজনশীলতা যেমন থাকতে হয় তেমন থাকতে হয় পরিশ্রম করার মানসিকতা। একমাত্র লেখালেখিই একজন মানুষকে সমাজের কাছে লেখক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতে পারে। আমি এ যাবত যা লিখেছি সেটি কাউকে লেখক হিসেবে পরিচিত করার জন্য যথেষ্ট কি না আমি জানি না, তবে লিখছি এটাই সত্যি। লেখক হবার মতো কোন ইচ্ছা বা স্বপ্ন কখনো আমার মধ্যে ছিল না। তাই কোন পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে বা পরিকল্পনা করে লেখালেখির জগতে প্রবেশ করা সম্ভব হয়নি। অনেকের মতো আমিও স্কুলজীবনে শখের বসে কবিতা লিখতাম। ইন্টারমেডিয়েট পড়ার সময় কলেজ ম্যাগাজিনের জন্য আমার প্রথম গল্প লেখা। এরপর টুকটাক কিছু লিখলেও উল্লেখ করার মতো কিছু নয়। তবে পড়ার আগ্রহ ছিল প্রচণ্ড। বাবা শিক্ষক ছিলেন আর বইপড়া ছিল আমার মায়ের নেশা। বাড়িতে দৈনিক পত্রিকার পাশাপাশি ঈদসংখ্যা বা অন্যান্য পত্রিকা রাখা হতো। মায়ের সংগ্রহে অনেক বই ছিল। মোটকথা, একাডেমিক বইয়ের বাইরেও নানা ধরণের বইপড়ার একটা পরিবেশ আমাদের বাড়িতে ছিল যে কারণে সব ভাই-বোনের মধ্যে পড়ার অভ্যাস তৈরি হয়েছিল। বইপড়া নিয়ে অনেক চমকপ্রদ ঘটনা জীবনে বহুবার ঘটেছে। তো, পড়তে পড়তেই হয়তবা লেখার প্রতি একটা ঝোঁক তৈরি হয়েছিল।
২০১০ সাল থেকে সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে ছোট ছোট লেখা শেয়ার করতাম। অনেকেই আমার লেখার প্রতি তাদের ভালোবাসার কথা জানাতেন, পরবর্তী লেখা পড়ার জন্য অপেক্ষা করতেন বা আরো বেশিবেশি লেখার জন্য উৎসাহিত করতেন। তো আপনি যখন আপনার লেখার বিষয়ে পজেটিভ মূল্যায়ন এমনভাবে সরাসরি পেয়ে যাবেন স্বাভাবিকভাবে সেসব পাঠকের ভালোবাসার প্রতিও আপনার দায়িত্ব বেড়ে যাবে। আমার ক্ষেত্রে সেটি ঘটেছিল। সেই সময়ে কিছু অনলাইন প্ল্যাটফর্মে গল্প লিখে কয়েকটি পুরস্কার পেলাম। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় গল্প, প্রবন্ধ ছাপা হতে লাগলো। সেসব প্রকাশিত গল্প নিয়ে ২০১৩ সালে আমার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘একটি প্রশ্নবিদ্ধ জন্ম’ প্রকাশ পায়। এই পর্যন্ত আমার মোট নয়টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে তিনটি উপন্যাস এবং ছয়টি গল্পগ্রন্থ।
সৃজনশীল এই জগতে যে কারণেই প্রবেশ করি না কেন, ধীরে ধীরে এটি একটি দায়বদ্ধতার জায়গায় পরিণত হয়েছে। সেই দায়বদ্ধতা সামাজিক, নৈতিক, রাষ্ট্রিক, সাংস্কৃতিক সকল ক্ষেত্রে। আমি বিশ্বাস করি একমাত্র লেখকরাই পারেন তাদের কলমের মাধ্যমে সমাজের অন্ধকার জায়গাগুলোকে চিহ্নিত করতে এবং সেখানে আলোর রশ্মি ফেলে আঁধার দূরীভূত করতে। অন্যায় অবিচার বৈষম্যসহ সকল অনাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে লেখনী যতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারে অন্য কোনকিছু ততটা নয়। তাই লেখা আমার কাছে শুধু পাঠকের চাওয়া, আমার আত্মিক তৃপ্তি বা আর্থিক নিরাপত্তা নয়, লেখা আমার কাছে মানুষের কাছে পৌঁছানোর শক্তিশালী মাধ্যম বটে!