কথাসাহিত্য ছোটগল্প বিশেষ সংখ্যা

মুয়িন পারভেজ | বেশটমেটো | ছোটগল্প

এরশাদউল্লা নয়াহাটে রটাইয়া দিছে যে বেশটমেটোরে সে বটফল খাইতে দেখছে মাজারখোলার টিলায়, যখন দুপুরবেলা দোকান বন্ধ ক’রে সে বাড়ি ফেরার পথে পেচ্ছাবের তাড়নায় মাটির ঢেলা খুঁজতেছিল; টিলার-ধারে-গড়িয়ে-পড়া শুকনো মাটির বড়ো একটা চাঙড়ে হাত বাড়াতেই তার সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে যায় বেশটমেটোর। রাস্তার দিকে বুড়ো বটগাছের যে-ডালটা ঝুঁকে আছে তার উপর পা ছড়াইয়া বসছিল বেশটমেটো। বাপের বয়েসি লোকটারে এভাবে পাখির ধরনে বটফল খাইতে দেখে খুব অবাক হয় এরশাদউল্লা, পেচ্ছাবের বেগ ভুলে সে হাঁ ক’রে তাকাইয়া থাকে কিছুক্ষণ, এরপর তার পেট ফুঁড়ে বেদম হাসি কলকলিয়ে বেরিয়ে আসে জান-কাটা পুকুরের পানির তোড়ের মতো; হাসতে হাসতেই ঢেলাসহ তার হাতে বেসুরো তালি বেজে ওঠে আর মুখে ধ্বনিত হয়, ‘বেশটমেটো, বেশটমেটো, কু-উ-কু-উ!’

সেদিন হাটবার। সন্ধেবেলা যখন দোকানসুদ্ধ লোকজন হো-হো ক’রে হেসে উঠছিল এরশাদউল্লার কথায়, ঠিক তখনই বেশটমেটো বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে বেরিয়ে আসতেছিল রমজান আলির চা-দোকান থেকে। হুদিন-বারিষা লোকটার লুঙ্গি ওঠানো থাকে হাঁটুর উপরে, মুখে খোঁচা-খোঁচা শাদা দাড়ি। চুলে কখনও চিরুনির আঁচড় পড়ছে ব’লে মনে হয় না, চুলও অবশ্য খুব বেশি মালুম হয় না। গায়ে একটা কচুর-কষ-লাগা হাফহাতা গেঞ্জি, বেটেখাটো বেশটমেটোর ঊর্ধ্বাঙ্গে দর্শনীয় কেবল তার গরুর মতো আশ্চর্য সরল দুইখানা চোখ। একদিকে—কোন দিকে ঠিক বোঝা যায় না—তাকাইছে তো তাকাইয়া আছে, হাসতেছে তো হাসতেছেই মিটিমিটি। ‘ছালামতউল্লা’ বললে গাঁয়ের কেউ চিনবে না তারে সহজে, কিন্তু ‘বেশটমেটো’ নামটাই বা কেন? এরশাদউল্লার কাছেই হয়তো জানা যাবে শানে নুজুল। লোকটা না কি কথায়-কথায়, মানে কারও কোনও কথা শুনলেই ব’লে ওঠে, ‘বেশ বেশ!’ ‘টমেটো’র হদিশ অবশ্য পাওয়া যায় না। এমনও হইতে পারে যে হাটে টমেটো বেচতে গেছিল লোকটা আর কেউ টমেটোর মস্ত বেঢপ খাঁচিটা দেখে হেসে বলছিল, ‘বেশ বেশ!’

যেভাবেই নাম হোক, বেশটমেটোরে নিয়ে দারুণ মুখরোচক একটা গল্প চালু আছে গাঁয়ে। না, এরশাদউল্লা নয়, গল্পটা পাকাইছিল জালাম্মদ সুই—ফটিকছড়িখালের দক্ষিণকূলের জালাল আহম্মদ সুফি। এজন্যই বোধহয় গল্পটা বিশ্বাসযোগ্যতা পেয়ে গেছে বেশি। বছর কয়েক আগে জালাম্মদ সুইয়ের পিনপিন্যার জমিতে হাল দিছিল বেশটমেটো। আষাঢ় মাস হইলেও রোদ কড়া। সকাল ন-টার দিকে জালাম্মদ সুই পান্তাভাত নিয়ে এসে দেখতে পায় যে আলের উপর লাঙলের ফালটা প’ড়ে আছে, কিন্তু তখনও বেশটমেটো বলদজোড়া দিয়ে হেঁট-হেঁট ক’রে একমনে লাঙল চালাইয়া যাইতেছে কাদাপানিতে। ফাল ছাড়া লাঙল চলতেছে কীভাবে! বিস্মিত জালাম্মদ সুই সে-কথা জিজ্ঞেস করতেই বেশটমেটো না কি নির্বিকারভাবে জবাব দিছিল, ‘হেই চ্যাং তো হানিভাতের আগে হরি গেছই!’ বলে কী লোকটা! পান্তাভাতের বহু আগেই ফাল খুলে প’ড়ে গেছিল লাঙল থেকে! জবাব শুনে প্রথমত অবাক হইলেও আচমকা হাসতে হাসতে পেটের চামড়া যেন ছিঁড়ে পড়তেছিল জালাম্মদ সুইয়ের।

বেশটমেটোর আদিনিবাস ছিল সন্দ্বীপ। উনিশশো ষাট ও সত্তরের ঘূর্ণিঝড়ে সন্দ্বীপের লোকজন উদ্বাস্তু হয়ে দলে-দলে ছড়াইয়া পড়ছিল চট্টগ্রামের নানা অঞ্চলে, বিশেষত উত্তর-চট্টগ্রামের উঁচু বা পাহাড়ি গাঁ-গেরামে। বড়বিলেও আছে একাধিক সন্দ্বীপ্যাপাড়া। আছরের ঢেবায় গেলে তো আপনার মনে হবে ঘুরতে ঘুরতে এসে পড়ছেন হুদ্রাখালী বা মাইটভাঙ্গায়। দক্ষিণকূলেও গেলেও পাইবেন সন্দ্বীপের বহু মানুষ। বড়ো একটা পাড়া গ’ড়ে উঠছে সেখানে। সবাই মুসলমান। খাবারদাবারে, আচরণে বড়বিল্যাদের সঙ্গে কিছু পার্থক্য তো আছেই, কিন্তু ওদের চট ক’রে চিনে ফেলা যায় কেবল মুখের বুলিতে। জ্যৈষ্ঠের গরমের দিনে রোজা পড়ছে একবার। পুকুরের মাটি কাটতেছিল সন্দ্বীপের একদল মাইট্যাল। দুপুরবেলা গাছতলায় বড়ো একটা খাজাকাঠ্‌ঠল নিয়ে ওরা ব’সে গেছে খাইতে। মউ-মউ করতেছে বাতাস পাকাকাঁঠালের ঘ্রাণে। হাটুরে কেউ যাইতেছিল তখন আলপথ ধ’রে, বিস্ময়ে সে রোজার কথা স্মরণ করাইয়া দিতেই, গতিকে মাইট্যালদেরই একজন ছিল বেশটমেটো, সোৎসাহে সে না কি জবাব দিছিল, ‘আরে, রোজা তো হামু হামু, হুককূল্যে কাঁডাল নি আর হামু!’ সে-কথা নিয়েও বেশ হাসাহাসি চলে আজও চা-দোকানে।

সন্দ্বীপ-আগত লোকদের মধ্যে কেউ-কেউ বেশ পয়সাওয়ালা, বড়বিলে প্রচুর জমিজিরেত কিনে ওরা রীতিমতো খানদানি তবিয়তে থাকে। বেশটমেটোর বাড়ি সন্দ্বীপ্যাপাড়ায় নয়, আছরের ঢেবায়ও নয়। দক্ষিণকূলে পিনপিন্যায় হিন্দুপাড়ার কাছে কয়েক ঘর সন্দ্বীপের লোক থাকে, ওখানেই বেশটমেটোর কুঁড়েঘর। খালের ভাঙনে সেই কুঁড়েঘরও যায়-যায় করতেছে রানিক্ষেত-আক্রান্ত মুরগির মতো। খালের পাড় বা টিলা যেখানে প্রায় খাড়াখাড়ি ভেঙে গেছে, যাকে আমরা বলি কাবগর, সেখানে একটা বেলগাছের শিকড় বে-আব্রু হয়ে নেমে গেছে নীচে; বেশটমেটোরেও দেখা যাবে খালি গায়ে সকালবেলা নেমে আসতেছে আধময়লা লুঙ্গিটা হাঁটুর উপর প’রে বা গিঁট মেরে, মুখে সেই লাখেরাজ বিড়ি। তারে দেখে কৌতুকবশত কিংবা তামাকপোড়া গন্ধে ফুরফুরে একটা মেজাজ ফিরে পেয়ে হয়তো আপনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কন্ডে যজ্জে অ দাদা?’ প্রথমত জবাব দেবে না, কানেও যে কম শোনে লোকটা! গোঁফদাড়ির আড়ালে অদ্ভুত এক অমীমাংসিত হাসি গুঁজে রেখে, খালের হাঁটুপানি পেরিয়ে খানিকটা উপরে উঠে বালুচরের একধারে সে তখন ঢুকে পড়ছে মফজল মাতবরের বেগুনখেতে।

গত সনের কথা, বেশটমেটোর ছোটো মেয়েটা তখন গর্ভবতী। মাদ্রাসার নোয়াহুজুরের মিঠাপড়া না কি খুব ওস্তাকারি; সেই মিঠাপড়া খেলে প্রসব নির্বিঘ্ন হয়। এক শনিবারের হাটে বেশটমেটো গেল মিঠা কিনতে। নয়াহাটের পুবমাথায় ইসলাম সদাগরের দোকান। তক্তাঘেরা টিনের চালের দোকান। সদাগরের সঙ্গে গল্প করতেছিল মেম্বরের ছেলে শফি। চিকনা বুদ্ধি ও রসিকতার জন্য নাম আছে শফির। তার বাপ নজির আহম্মদ মেম্বররে কেউ কোনওদিন ঠাট্টামশকরায় কুপোকাত করতে পারছিল ব’লে নজির নাই। মিঠা আছে কি না জানতে চেয়ে বেশটমেটো ‘না’ উত্তর শুনে খানিকটা হতাশ হয়ে মুখ ফিরাইছে, তখনই শফি বলল, ‘শকতর বঅর ফার্মেসিত যাই চ, মিডে পাইবে।’

ওষুধের দোকানে যে মিঠা পাওয়া যায় না—এই জ্ঞান সেদিনই প্রথম বেশটমেটোর হইল শওকতের বাপের বকা খেয়ে। আরও খানিকটা ঝাল খাইতে হইল উপস্থিত দিল মোহম্মদ পাটোয়ারির কথায়, ‘এন্ডিল্যা বেকুব গাছত নি ধরে!’ পেরেশান হয়ে বেশটেমেটো আবার ফেরত আসে ইসলাম সদাগরের দোকানে। কপাল কুঁচকানো, মুখে ছাগলের-গুঁতা-খাওয়া হাসি। শফি তখন চোখের ইশারা দিতেই সদাগর বলল, ‘একখানা থিঅ বাআজি, মিডে থোরা আছে নি চাই।’ পেছনের অন্ধকার কুঠুরিতে গিয়ে কালচে ঝুরামাটির একটা দলা কাগজে মুড়ে এনে বেশটমেটোর হাতে দিয়ে সদাগর বলল, ‘টিঁয়া লাইগদু ন, যগই।’

বেশটমেটো বেশ ফুল্লমনে, কৃতজ্ঞতায় ঘাড় কাত ক’রে ইসলাম সদাগরের দোকান থেকে বেরিয়ে এসে সেই মোড়ক নিয়ে গেল নোয়াহুজুরের কাছে। মোড়ক না খুলেই হুজুর দোয়াদরুদ ফুঁকে মিঠাপড়া খাওয়ার তরিকা শিখাইয়া দিলেন। বাড়ি ফিরে এসে বেশটমেটো মেয়ের হাতে মিঠাপড়ার ঠোঙা দিয়ে কী শুনতে পাইছিল তা আমাদের অজানা, কিন্তু পরের দিন হাটে এসে রমজান আলির চা-দাকানে খোশমেজাজে যে-গল্পটা সবাইরে সে শুনাইছিল তার সারমর্ম এই যে, এরকম আশ্চর্য কেরামতি সে দেখে নাই জীবনে—নোয়াহুজুর ফুঁ দিলে মিঠা পর্যন্ত মাটির দলা হয়ে যায়!

বছর চারেক আগে, এক চৈতমাসের দিন, মনে হয় সেদিন ছিল বিষুদবার, দুপুরবেলা আমরা উত্তরের জমিতে মাপজোখের কাজে হয়রান। হঠাৎ খবর আসে, কাজিরহাটে খুব গণ্ডগোল চলতেছে, কোন দলের না কি হরতালবিরোধী মিছিলে কিরিচ-লাঠিসোটা নিয়ে হামলা করছে কয়েকশো বদরাগী মানুষ। মসজিদের মাইকে না কি ঘোষণা দেওয়া হইছিল যে ছেলেরা আক্রমণ করছে মসজিদে বা মাদ্রাসায়। যাদের কলিজা বড়ো, তাদের কেউ-কেউ দেখতে গেছিল ঘটনা; গাঁয়ে ফিরে এসে নানা ঢঙে ছড়াইছে গল্পের খই। না, কী বলে মউতুন সাবকেও তুলে নিতে চাইছিল ওরা গাড়িতে, সেখান থেকেই মারামারির সূত্রপাত। যা-ই ঘটুক, পরদিন পুরো গাঁয়ের চেহারা গেল বদলাইয়া। দলে-দলে পুরুষলোকেরা পালাইয়া যাইতেছে গাঁ ছেড়ে, কাঁধে বোঁচকা। যেদিকে চোখ যায় দেখি শরণার্থী-প্রবাহ। রাস্তায়, খালবিলে, এমনকী টিলার ঢালুতে পর্যন্ত মুহাজিরের দল।
জানা গেল, অবস্থা সাংঘাতিক। কাজিরহাটের হামলায় মারা গেছে কয়েকজন, ন্যাশনাল ইস্কুলে ঢুকেও রক্ষা পায় নাই কেউ-কেউ। কচুগাছরেও মানুষ এমন নির্দয়ভাবে কোপায়! এরই মধ্যে না কি কোপাকুপির ভিডিয়ো ভাইরাল হয়ে গেছে ফোনে-ফোনে। সদর রাস্তার দুইধারে পোড়া মোটরসাইকেল কয়লার দলা হয়ে প’ড়ে আছে বেশুমার—কুরুক্ষেত্র হয়ে গেছে একদম। ‘দৈনিক বীর চট্টগ্রাম মঞ্চ’র প্রথম পাতার খবর ও ছবির দিকে বেশিক্ষণ তাকানো যায় না।

ফৌজদারি মামলা আর টানাহেঁচড়া যে হবে তাতে সন্দেহ নাই। বড়ো আশঙ্কার কথা এই যে, ভূজপুর বা কাজিরহাট থেকে চার মাইল দূরে হলেও বড়বিলে পুলিশ এসে পড়তে পারে যে-কোনও সময়। নয়াহাটের আশেপাশে ভিড় ক’রে আছে গাঁয়ের সন্ত্রস্ত লোকেরা; কেউ ‘আইয়ির লেএএএ’ ব’লে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় দিলেই ভেড়ার মতো প্রাণপণে ছুটতেছে সবাই, পিছন ফিরেও দেখতেছে না আদৌ কেউ আসতেছে কি না। কেউ-কেউ টিলার ঝোপের ভিতরে আশ্রয় নিয়ে সতর্ক চোখ রাখতেছে পুবদিকের রাস্তায়। সন্ধে না হতেই আমরা মোটামুটি বরফ হয়ে গেলাম ভয়ে। রাতে বাড়িতে থাকা নিরাপদ নয় ভেবে চ’লে গেলাম দক্ষিণকূলে হিন্দুপাড়ায়, সুবল মহাজনের বাড়িতে। যা-ই হোক, হিন্দুবাড়িতে অন্তত পুলিশ তল্লাশি করবে না এ-ঘটনায়। মহাজনের ছেলেদের চোখেমুখেও অবশ্য তেমন দেখা গেল না আতঙ্কের ছাপ। মানিক কাকা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা, যুদ্ধের গল্পকথায় আমরা চ’লে গেলাম পুরোনো দিনের আবছা জলে-ডাঙায়।
‘তোঁয়ার দাদার কাছারিঘরত থাইকতাম আঁরা। ইয়েন আছিল আঁরার ক্যাম্প। জ্যাডা ধানর গোলা খুলি দিইয়িল আঁরার লাই।’ বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে বলতেছিলেন মানিক কাকা।
‘দাদা তো মুসলিম লীগোর সমর্থক আছিল ফঁরলার!’ মুখে চিড়াভাজা নিয়ে বলতে গেলাম আমি।
‘লীগ-টিগ কিছু ন ভাইপুত, হেঁত্তে মানুষ আছিল দেশত।’
বিড়ি নিভে গেছিল। আবার অগ্নিসংযোগ ক’রে মানিক কাকা গল্পের খেই ধরেন। কোমরে-দড়িবাঁধা হতভাগী বউঝিয়েরা গা ধুইতে নামতেছে খালে—এই দৃশ্য মানিক কাকারে বিবশ ক’রে দেয় এত বছর পরেও।

আমরা খাটে গুটিসুটি মেরে বসছিলাম থমথমে-অন্ধকারের-গোবরে-লেপা বারান্দার কোনায়। একটা জোনাকিপোকা মাঝেমধ্যে চেরাগ ধরানোর চেষ্টা করতেছে পুকুরপাড়ের ঝোপে। নির্মল কাকা চা-বিস্কুট নিয়ে এলেন। ভ্যাপসা গরমে আর মশার কামড়ে রাতটা কাটল কোনওমতে। সকালে ঠিক হলো, রাঙাপানি চা-বাগানের পথ ধ’রে আমরা চ’লে যাব বিবিরহাট বা শহরের দিকে, হাজারিখিলের লালাহাট পর্যন্ত এগিয়ে দেবেন নির্মল কাকা। চা-নাশতা সেরে, ঘর থেকে বের হওয়ার মুখে দেখা হইল পলায়নপর আরেকটা দলের সঙ্গে। মজিদ বদ্দার দল। সবার চোখেমুখে যেন পালকের পরশ লাগাইয়া দিছে পেঁচা। ওরা বারইয়ারঢালার পাহাড়ি পথে চ’লে যাবে সীতাকুণ্ডের দিকে। কেউ কুমিরায়, কেউ বা বাঁশবাড়িয়ায়। বিপদ-আপদেই না কুটুমবাড়ি চেনা যায়!

সরু আঁকাবাঁকা পথ ধ’রে হাঁটতেছি। ঝোপঝাড়ের ভিতর থেকে এক বুনো গন্ধ এসে ছাগলছানার মতো পথ আগলে দাঁড়াইতেছে বারবার। পিনপিন্যাছড়ার হাঁটুপানিতে নেমে, পাড়ে উঠে বেশ খানিকটা এগিয়ে গেছি, নির্মল কাকার গল্প শুনতে শুনতে। বাম্পার রফিকের কথা উঠল। বাম্পার বা জাঁদরেল গোঁফের জন্য সে অতিশয় নামজাদা। ভূজপুরের ঘটনায় ভয় পেয়ে সে না কি বাড়ি ছেড়ে পালানোর আগে বিসর্জন দিছে তার সাধের বাম্পারখানা!

হাঁটতে হাঁটতে নাথিঙ্গ্যাপাড়া চ’লে আসছি ততক্ষণে। ত্রিপুরা মেয়েরা কলসিমাথায় জটলা পাকাইয়া আছে খালের কুম্ভের ধারে। আরেকটু এগোলেই চড়াই। দুপাশে গাছে-ঢাকা টিলা। ঝিঁঝিঁপোকার ডাক আর নানা পাখির শিস। হঠাৎ চোখে পড়ল, একটা শিমুলগাছের গোড়ায় ব’সে একমনে বিড়ি ফুঁকতেছে বেশটমেটো! কোনও ছেদভেদ নাই তার। গাঁয়ে যে এত কাণ্ডকীর্তন ঘটতেছে তা আদৌ জানে ব’লেও মনে হইল না। আমাদের দেখে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে হেসে ফেলল, যেভাবে সে হাসে; এরপর বিড়িতে শেষটানটুকু দিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে উঠে দাঁড়াইল। পরনে সেই আধময়লা লুঙ্গি, হাঁটুর কাছাকাছি গোটানো। কিছুই না ব’লে আমাদের পাশ কাটাইয়া নির্বিকারভাবে সে হেঁটে গেল দ্রিমিকি-দ্রিমিকি তালে।

কৌতূহলবশত আমি পিছনে ঘাড় ফিরাইয়া দেখলাম। দেখে নিজের চর্মচক্ষুরেও বিশ্বাস করতে পারতেছি না! কোথাও নাই বেশটমেটো—শিমুলতুলার মতো মিলাইয়া গেছে বাতাসে! কেবল একটা হট্টিটি টি-টি করতে করতে উড়ে চলল পিনপিন্যাছড়া পেরিয়ে, মাতবরের বিল পেরিয়ে, হয়তো-বা দূরের সেই মাজারখোলার দিকে।

মুয়িন পারভেজ

জন্ম: ২৬ আগস্ট ১৯৭৬। জন্মস্থান: ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ : ‘মর্গে ও নিসর্গে’ [২০১১, ঐতিহ্য, ঢাকা], ‘সঞ্জয় উবাচ’ [২০১৯, কবিতাভবন, চট্টগ্রাম]। সম্পাদিত (যৌথ) কবিতাসংকলন : ‘ক্রৌঞ্চগীতি’ [প্রথম প্রকাশ: ২০০০, আক্ষরিক, চট্টগ্রাম]।

    Leave feedback about this

    • Rating

    PROS

    +
    Add Field

    CONS

    +
    Add Field