দরজাটা পুরোই ভেজানো। আধভেজা জানালার ফাঁক দিয়ে মেঘে খাওয়া ধূসর রোদ ঘরের ভেতরে গলে গলে পড়ছে নিতান্ত অনিচ্ছায়, কিছুটা কুণ্ঠায় আর যেন কিছুটা লজ্জায়ও। সেদিকে চোখ যেতেই হঠাৎ ঘুরে ওঠে রহমতের মাথাটা। দীর্ঘক্ষণ অব্যবহৃত পড়ে থেকে হঠাৎ স্টার্ট নেয়া গাড়ি যেমন নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে, তেমন। এটা কী দেখলো সে! দৃষ্টিতে ধরা পড়ে যাওয়া মুহূর্তের একটা দৃশ্য। সেই দৃশ্যের এমন তীব্র ঝাঁঝ! তুমুল ঝাঁকুনি! সেই ঝাঁঝ ঝাঁকুনিতে টাল সামলাতে না পেরে আধা বারান্দা আর আধা উঠানে হুমড়ি খেয়ে পড়ে রহমত। দুনিয়া আন্ধার করা যে অন্ধকার সে মুহূর্তে দু-চোখ অন্ধ করে দেয় রহমতের, রহমতের মনে হয় এর নামই বোধহয় কিয়ামত। আর হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে যে চিৎকারটা সে দেয় তার নাম অভিধানে আছে গগনবিদারী। তারপর জ্ঞান হারায় রহমত।
গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে সুধর দেখে চারদিক থেকে ধেয়ে আসা মেঘের দল আরো যুথবদ্ধতায় কালো হচ্ছে। চৈত্রের শেষে গাঢ় অন্ধকার রঙের মেঘ। এ রঙ বহুরূপী। প্রখর সূর্যকে স্বমহিমায় জায়গা ছেড়ে দিয়ে দিব্যি উধাও হয়ে যাওয়ার অভ্যাস আছে তার। আবার পুনরায় ফিরে আসার অভ্যাসও আছে। প্রচণ্ড রূপে ডালপালা উড়িয়ে, হলকা পলকা সব টিন, ছন ছাউনি উড়িয়ে ফিরে আসে। সাবধানের মার নেই। রাস্তায় দাঁড়িয়েই পকেট থেকে মোবাইলটা খুলে রহমতকে ফোন দেয় সুধর। আসার সময় তার ঘর থেকে যেন ছাতাটা নিয়ে আসে। রহমতকে তার নিজের ছাতাটাও সাথে আনার কথা বলতে ভোলে না। বাতাসের গতি ধীরে ধীরে হামাগুড়ি দিয়ে বাড়ছে। অতর্কিতে টুপটাপ মাথায় পড়ছে দু-এক ফোঁটা বৃষ্টি। বরফ ঠাণ্ডা বৃষ্টির ফোঁটা। যে ফোঁটাগুলি বিচ্ছিন্ন, মুষলধারায় নয়। মাথায় পড়ে আটকে যায়, ধীরগতি আর অঝোর না হওয়ার কারণে দেহ বেয়ে মাটি পর্যন্ত যেতে পারেনা। কিন্তু এই বৃষ্টিটা বেড়েই যায় কিনা! ভাবতে ভাবতেই শার্টের পকেটে মোবাইলটা কেমন অলুক্ষণে ইঙ্গিতে বেজে ওঠে। রহমতের ছেলে মোহিত মিয়া। ‘আব্বাজান জানি কেমুন করতাছে’ হড়বড় করে কথাটা বলেই ফোনটা কেটে দেয় মোহিত। ছেলের কণ্ঠের উৎকণ্ঠা জানান দেয়, এর বেশি কথা বলার সময় বা অবস্থা কোনটাই নেই তার। সুধর দ্রুত পা চালায় রহমতের বাড়ির দিকে। দৌড়ে যাবার সময় চোখে পড়ে তার বাড়ির সামনে হাত পা ছড়িয়ে বসে আছে তার স্ত্রী চিত্রালী। কী হয়েছে ওর? অবেলায় এখানে এভাবে বসে আছে কেন? হোক যা কিছু। এখন ওর সাথে কথা বলার সময় নেই। এমন কতো পাগলামি করে চিত্রালী। রাতদুপুরে দরজা খুলে উঠানে হাঁটে। ভরদুপুরে বাড়ির পেছনের বিছরা বেয়ে নেমে চলে যায় ক্ষেতের আইলে। কতো বিকাল ওকে খুঁজে আনতে হয় পুকুর ঘাটলার গাছের গুঁড়ি থেকে। বেলা অবেলায় চিত্রালীর এমন পাগলামি দেখে অভ্যাস আছে সুধরের। ওর খবর পরে নেয়া যাবে। রহমতের কী হয়েছে আগে বোঝা দরকার। সুধর দৌড়ায় রহমতের ঘরমুখী।
অপার শান্তি ছিলো এই পাড়ায়। কোন অশান্তি কিংবা অ-সুখের অনুষঙ্গ কখনো তৈরি হয়নি এখানে। বাজারে যাওয়া ঘরে ফেরা সংসার কর্মে সবার সবকিছুতেই যেন অন্য যে কোন পাড়া থেকে অধিকতর স্বাভাবিক। রহমত আলীর ঘর, নিজাম মোল্লার ঘর, সুধরের ঘর এক পাড়ায় পাশাপাশি, কিন্তু কোন কারণে ঝগড়াঝাটি, মনোমালিন্য নেই। সবাই সবাইকে মেনে নিয়ে মানিয়ে নিয়ে স্বস্তিতেই থাকে।
বাজারে যাবার সময় একসাথেই যায় তারা। ফেরেও একসাথে। যাওয়ার সময়টা মোটামুটি সবারই জানা। সকালে ভরপেট আলুসিদ্ধ ভাত সরিষার তেলে মেখে খেয়ে পাঞ্জাবি পরে গলির মুখটাতে দাঁড়ায় কেউ একজন। রহমত কিংবা নিজাম কিংবা সুধর। যে আগে বের হয় সে অপেক্ষা করে বাকিদের জন্য। একসাথে ইজিবাইকে ওঠে। একসাথে যায়। ফেরার সময় যে আগে ঝাঁপ ফ্যালে সে দাঁড়ায় অন্যদের জন্য। এদের বউরাও একসাথে উঠানে পাপড়া শুকাতে দেয়, একসাথে শলা পরামর্শ করে কাঁচা আমের আচার দেয়। ভালো-মন্দ রান্না হলে এবাড়ি ওবাড়ি তরকারির বাটিও চালাচালি হয়।
পাড়ার মাঝে একমাত্র চিত্রালী একাই এক বিষাদের নাম। সে কারো সাথে মেশে না। কথা বলে না। সুধর বাড়ি ফিরলেই সুধরের সাথে খিটমিট করে। ছেলের সাথে হল্লাচিল্লা করে। তবু পাড়ার কেউ তাকে বিশেষ কোন দোষ দেয় না। কেউ তাকে ঘাটায় না। আসলেই বেচারির কষ্ট দেখলে বুক ফেটে যায়। একটা বিশ বছর বয়সের ব্যাটাছেলেকে টেনে হিঁচড়ে সব করানোর জন্য যতটা মনের জোর দরকার ততটা দরকার শরীরের জোর। তার উপর ছেলেটা একেবারেই অবুঝ। কিছু প্রয়োজন হলে বা তার মনমতো না হলেই চিৎকার চেঁচামেচি, ভাঙচুর। হাত পা ছোড়া। নির্বোধ গৃহপালিত পশুরও সময়মত খাবার পেলেই আর কোন চাহিদা নেই। ঠ্যাং লম্বা করে মাটিতে, গাছের ছায়ায় নিশ্চিন্তে ঘুমায়। কোথায় হাগে, কোথায় মুতে খবর রাখতে হয়না।
কিন্তু এ যে মানব সন্তান। মানুষের মতো হাত পা, নাক মুখ, খিদে খাওয়া, হাগা মুতা সব। শুধু মানুষের মতো মাথা নেই। মাথা থেকে কোন নিয়ন্ত্রণ নেই শরীরের। অথচ চারপাশের মানুষের কাছে একে মানুষ করে দেখানোর দায় আছে। ছেলের বাপ থাকে বাজারের দোকানে আর নাতির মুখ দেখার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়া শাশুড়ি নিশ্চিন্তে স্বর্গে ঘুমায়। হাঁপাতে হাঁপাতে চৌদ্দ পুরুষের নামে শাপশাপান্ত করে চিত্রালী। একে পরিষ্কার করে স্নান করাও, খাওয়াও,দাঁত ব্রাশ করে দাও। হাগা মুতার পর ধুয়ে দাও। শার্ট-প্যান্ট পরিয়ে মানুষ বানিয়ে রাখো! ক’বছর ধরে গালে সাবান ঘষে দাড়ি কামিয়ে ফিটকিরি ঘষে দিতে হয়। ঘামের দুর্গন্ধ থেকে বাঁচার জন্য বগলের লোম চেছে দিতে হয়। ভীষণ অসহায় আর কষ্টকর জীবন চিত্রালীর। সুধরও কষ্টটা টের পায়। ফলে পারতপক্ষে তাকে ঘাটায় না, মুখ বুঁজেই সহ্য করে সব পাগলামি।
এখনো জ্ঞান ফেরেনি রহমতের। এমন হাত পা ছেড়ে নিস্তেজ শুয়ে থাকা ভয় ধরিয়ে দেয় সুধরকে। মোহিত মিয়া আর সে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেনা। ইজিবাইকে পাঁজাকোলা করে রহমতকে নিয়ে দ্রুত হাসপাতালমুখী হয়, সময় নষ্ট করে না একটুও। দ্রুত চিকিৎসা করাতে হবে। হাসপাতালে যাওয়ার সময়ও একই জায়গাতেই, চিত্রালীকে হাত পা চিতিয়ে বসে থাকতে দেখে সুধর।
ঘরে পুত্র শ্রীবাসকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে এসেছে চিত্রালী। বড় ক্লান্ত লাগছে নিজেকে। বিয়ের পর পাঁচ পাঁচটি বছর একটা সন্তানের জন্য কী আকুলিবিকুলি। সুধরের বংশের প্রদীপ চাই। শাশুড়ির খোঁটা আর যখন তখন হা হুতাশ বিলাপে তার জীবন তখন নরকের মতো। খেতে শান্তি নেই, ঘুমাতে শান্তি নেই। সারাক্ষণ দীর্ঘশ্বাস আর তীব্র বেগে ছুটতে থাকা বাক্যবাণ। জীবনটাকে নরক করে দিয়েছিল মহিলা। ছেলে হলো ঠিক। কিন্তু চিত্রালীর জীবন আর নরক থেকে বের হতে পারলো না। একজীবন গেলো মা না হওয়ার বিষাদের নরকে, আরেক জীবন যাচ্ছে মা হওয়ার অভিশাপের নরকে।
কয়টা মাস ধরে রায়পাড়ায় একটার পর একটা দুর্ঘটনা ঘটছে। রহমত আলীর ছেলেটা বাইক এক্সিডেন্টে পা ভেঙেছে। নিজাম মোল্লার মেজো মেয়ের উপর পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে স্বামী। অল্পের জন্য বেঁচে গেছে মেয়েটা। একদিন চোরাই গাড়িসহ ধরা পরে জেলখানায় চালান হয়ে যায় করিমুল্লার মেজো ছেলে। আপদে বিপদে পাশাপাশি বাস করা ঘরগুলোতে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটতে থাকলে পাড়ার সবার মনে অজানা আশঙ্কার এক ভীতিকর বিষাদ ছড়িয়ে পড়ে। তারা যার যার মতো কারণ আর নিরাময়ের উপায় অনুসন্ধান করতে থাকে হন্যে হয়ে।
রহমত আলীর বউ নিয়ত করে বাড়িতে হুজুর ডেকে কোরান খতম দেয়। বাজার থেকে কিনে আনা ফার্মের মুরগির মাংসে আটনি পোলাও রান্না হয়। তার একবাটি সুধরের ঘরেও যায়। করিমুল্লা শুক্কুরবারে একটা আস্ত ছাগল সদকা দিলে গোটা পঞ্চাশেক ফকির মিসকিন দুপুরে পেটপুরে খায়। সুধরও কৈবর্ত্য পাড়ার গায়েনের দলকে ডেকে হরিনাম সংকীর্তন শেষে পেটচুক্তি খিচুড়ি খাওয়ায়। বিপদে উদ্ধার পেতে এভাবে সবাই যার যার মতো উদ্যোগ নিতে নিতেই আবার যখন নিজামের আট বছরের ছেলেটি নিখোঁজ হয় আর কয়েক ঘণ্টা পর তার লাশ রাস্তার পাশে পুকুরে ভেসে ওঠে তখন সবাই নড়েচড়ে বসে। এভাবে হঠাৎ করে ঘরে ঘরে দুর্ঘটনা ঘটতে থাকার কারণ কী।
ঝড়ের কবলে পড়া নৌকাযাত্রীর মতো বিপদে পড়া মানুষগুলো পরের জুম্মাবারে বাদ জুম্মা মসজিদে নামাজ পড়ে একত্রিত হয় রহমত আলীর বৈঠকখানায়। নানাজনের নানামত। পাড়ায় বদ নজর লাগছে, ভাদৈ গ্রামে একজন কবিরাজ আছে, ধন্বন্তরি। কেউ একজন তালিকা দিতে থাকে তার ঝারফুঁকে কার বারোমাসি রোগী একদিনে খাড়া হয়ে গেছে, কার জন্ম থেকে বয়ে চলা হাঁফানি রোগ সেরে গেছে। আরেকজন আপত্তির তাচ্ছিল্যে প্রসঙ্গটি ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেয়, ধুর এইতা আজকাইলকার দিনে কেউ বিশ্বাস করে?
রহমতের ছেলে মোহিত মিয়া সম্প্রতি মাদ্রাসা থেকে আলেম হয়ে ফিরেছে। সেই প্রথম কথাটা ওঠায়। পাড়ার মুখে সে একটা মসজিদ দিতে চায়। প্রায় তিন দশক পার হয়েছে পাড়ায় মুসলিম বসতির। এখনো পাড়ায় একটা নিজস্ব মসজিদ নাই। বিধর্মী সুধরের বউটা সকাল সন্ধ্যা ধুপধুনা জ্বালিয়ে কাঁসর ঘণ্টা বাজায়, এই পাপেই পাড়ার এই অবস্থা। এদেরকে আগে এই পাড়া থেকে বিদায় করতে হবে। রহমত ক্ষেপে ওঠে সবার আগে। সুধরের কারণেই সবাই এ পাড়ায় উঠে এসেছে, বাড়িঘর করে স্থিত হতে পেরেছে। আর এই সুধরকে পাড়া ছাড়া করবে এমন নিষ্ঠুর আচরণ সে করতে পারে! ছেলেকে কড়া শাসনে থামিয়ে দেয় সে। ছেলে ভেতরে ভেতরে দুমড়ানো কাগজের মতো গজগজ করলেও ভরা সভায় বাপের মুখের উপর কিছু বলার বেয়াদবি করেনা। উত্তপ্ত হয়ে ওঠা পরিবেশের আঁচে সবাই নীরবে যে যার মতো চলে যেতে থাকলে সভা শেষ হয়ে যায় কোন সিদ্ধান্ত ছাড়াই।
রায়পাড়ার নামটার সাক্ষী হয়ে সুধর রায় একাই এখনো আছে পাড়ায়। প্রায় চল্লিশ পয়তাল্লিশ ঘর ছিলো এরা। পাড়া ছাড়ার হুজুগ উঠলে, তুচ্ছ অজুহাতেও বাড়িঘর বিক্রি শুরু হয়। অজুহাত না থাকলে অজুহাত তৈরি করে কেউ কেউ। একজনের দেখাদেখি আরেকজন। প্রায় সবাই একে একে পাড়া ছাড়তে থাকলে পাশাপাশি দোকানি, ব্যবসার খাতিরে বন্ধু হয়ে ওঠা রহমতকে ফুঁসলিয়ে জায়গা কিনিয়েছিলো সুধর। পরে রহমতের পথ ধরে আসে বাকিরা। এরা দলবেঁধে পাড়ার নাম বদলের আবেদনও করেছিলো একবার। চেয়ারম্যান আবেদনটি এদের সামনেই ছিঁড়ে ফেলে, রাগে নয়, বরং খুব নরম স্বরে বলেছিলো, আছেই ত খালি নামডা। বদলাইয়া কী এমন লাভ অইবো আপ্নেরার? তারপর এই প্রক্রিয়া আর আগায়নি।
রায় পাড়ার রায়দের পাড়া ছাড়ার অজুহাতগুলো খুব একটা বড় না হলেও তুচ্ছও নয়। কারো ঋণের দায়, কারো মেয়ে ধর্মান্তরিত হওয়ার লজ্জা নানা কারণে তারা রায়পাড়ার নাম অচল করে বাপ দাদার ভিটেবাড়ি বেচে দিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়! এই শহরেই এদিকে সেদিকে, জেলা সদরে। আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে কাছাকাছি ভারতের ত্রিপুরার আগরতলা শহরেও গেছে কেউ কেউ।
চারদিকে মুসলিম পরিবেষ্টিত সুধরের বাড়িতে কালেভদ্রে ওরা কেউ আসে। সুধরকেও চলে যাবার পরামর্শ দেয়। এভাবে মুসলমানদের মাঝে কীকরে থাকে সুধর, ভেবে তারা অবাক হয়। সুধর ঠাণ্ডা গলায় তাদের জানায় প্রতিবেশীদের সাথে তার এমন কোন বাদ বিবাদ নেই যে তাকে চলে যেতে হবে। বড় জ্যাঠা, ছোটকাকা, সোনাকাকারা সবাই যে যার মতো পাড়া ছেড়ে চলে গেলে সুধরও ভেবেছিলো চলেই যাবে। কিন্তু একমাত্র ছেলের জন্ম তার চিন্তার জগতে আমূল ঝড় তুলে সব প্রথাগত ভাবনার শেকড় নাড়িয়ে দিয়েছে। কার জন্য বান্ধো বাড়িঘর… ভাবনায় সে আবিষ্কার করেছে এই বংশের প্রদীপ, জাতপাত সব মিছে মায়া। অতর্কিতে পাওয়া জীবনকে উপভোগ করার বাহানা। তার দাদা, তারও দাদা,তারও দাদা এরাও নিশ্চয়ই এভাবে ভেবেছিলো। কই তাদের বংশের প্রদীপ সুধর তো পূর্বপুরুষদের নামও জানেনা। বেঁচে থাকতে হবে বেঁচে থাকার জন্য। সে বেঁচে থাকা ভালো হলে ভালো, মন্দ হলে ভালো করার চেষ্টা করা যায়। কিন্তু কিছুই কী আর পুরোপুরি ভালো বা পুরোপুরি মন্দ হয়?
বিয়ের পাঁচ বছর পর তখন সুধরের বউ চিত্রালী সুধরের একমাত্র ছেলেটার জন্ম। ছেলেটা একটু বড় হলে গোছগাছ করে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সুধর। কিন্তু ছেলেটা যতোই বড় হতে থাকে সুধরের চিন্তার জগতে দমকা হাওয়ার ঝড় শুরু হতে থাকে আর চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল হতে থাকে। আর এখন যাওয়ার কথা মোটেই ভাবেনা সে। কই যাবে কেনোই বা যাবে। ওর আছেই বা কী! কার জন্য কিসের জন্য মানুষ বাঁচে? এই ঔরসজাত ছেলেটা যদি সুস্থ হতো তবেই বা কী হতো? বাপের নাম রক্ষার জন্য নিজের জীবন জলাঞ্জলি দিতো? সে নিজে দিয়েছে? বাপের কথা কয়বার মনে করে সে?
একমাত্র ছেলেটা যখন জন্ম নেয় কিংবা জন্মের পর বছর খানেক বোঝা যায়নি এর কোন সমস্যা আছে। ধীরে ধীরে প্রকট হতে থাকে অসঙ্গতিগুলি। শরীরের চেয়ে মাথার ওজন বেশি ছেলেটার। গঠন ঠিক নেই। বুদ্ধির বিকাশও ঠিকঠাক নয়। জগত সংসার সম্পর্কে মোহ কেটে যায় সুধরের। এই জগত সংসার মিছে মায়া, খুব বেশিদিন লাগেনি নিজেকে সান্ত্বনা দিতে। কিন্তু মিছে মায়া বলে নিজেকে সান্ত্বনা দিলেই তো আর একমাত্র পুত্রের জৈবিক বৃদ্ধি থেমে থাকেনা! ছেলেটা কথা বলতে পারেনা। নিজে নিজে পায়খানা প্রস্রাব করতে পারেনা। একটা নির্বোধ পোষা প্রাণীর মতো সারাদিন সিলিংয়ের দিকে ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে সটান হয়ে শুয়ে থাকে। না নির্বোধ পোষা প্রাণীও চার পায়ে হেঁটে বেড়ায়। ছেলেটা তাও পারে না। শুধু খিদে পেলে পোষা প্রাণীর চেয়েও দ্বিগুন স্বরে চেঁচাতে পারে। শুধু চেঁচিয়ে ক্ষান্ত হয়, হাত পা ছুঁড়ে এমন ভয়াবহ পরিবেশ তৈরি করে যার চাপ সহ্য করা যে কোন স্বাভাবিক মানুষের জন্য কঠিন।
কোনকিছু প্রয়োজন হলে নির্বোধ পশুর মতো চিৎকার করে ছেলেটা। পাঁচ বছর কতো ঝাড়ফুঁক তাবিজ কবজের পর এই ছেলের জন্ম। কেউ সামলাতে পারেনা একে। সুধর না, সুধরের মা না। কেউ না। শুধু চিত্রালী জানে এই ছেলেকে কীভাবে সামলাতে হয়। পেটে ধরা ছেলেটার জন্য মায়া হয়, শরীরের শক্তি দিয়ে টানতে টানতে বিরক্ত লাগে। ক্লান্তি আর হতাশায় ভেঙে গুড়িয়ে যায় একেকবার। কিন্তু ফেলেতো আর দিতে পারেনা গর্ভেধরা ছেলেকে।
একদিন বিছানায় গুয়েমুতে লেপ্টে থাকা ছেলেকে ধুয়েমুছে পরিষ্কার করে দিতে দিতে হঠাৎ গর্ভেধরা ছেলে বিছানায় সর্বশক্তিতে চেপে ধরে তাকে। প্রথমটায় বুঝতে পারেনি চিত্রালী। যখন বোঝে তখন ছেলেকে বাধা দেয়ার কোন শক্তিই থাকে না তার। বরং তারপর দিন থেকে প্রতিদিন আত্মসমর্পিত হয় সে। পুরদস্তুর প্রাপ্তবয়স্ক একটা ছেলের যে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়ার মধ্যে শরীরের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য জৈবিকতা যৌনতাও আছে, কেউ তলিয়ে ভাবেনি কোনদিন। চিত্রালী প্রথম যেদিন ছেলের সাথে পেরে ওঠেনা সেদিনই আবিষ্কার করে এই বিশ বছর অবধি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করা ছেলেটা একমাত্র এই একটা কাজের পরই একেবারে গলে ঠান্ডা হয়ে যায়। কোনকিছু নিয়েই আর জ্বালায় না। ছেলেকে সামলাতে গিয়ে বিশটি বছর ধরে শারীরিক আর মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়া চিত্রালী নিজেকে সমর্পণ করে যেনো মুক্তি পায়।
সুধরই অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে রহমতকে হাসপাতালে পাহারা দেয়ার জন্য রাতটা থেকে যায়। ধীরে নীরব হয়ে আসতে থাকে হাসপাতালের পরিবেশ। রোগীর আত্মীয় স্বজনদের ভিড়ভাট্টা হল্লাচিল্লা থেমে যায়। দিনভর হরেক রকম রোগীর অসহ্য রোগযন্ত্রণার বিচিত্র গোঙানি কমে আসতে থাকে। রহমত চোখ খুলে সুধরকে দেখেই ভূত দেখার মতো চমকে চোখ বন্ধ করে ফেলে আবার। সুধর জানে রহমত কেন এমন করছে। এবার বোধহয় পাড়াটা ছাড়তেই হবে তাকে। সমাজ সংসার যা অন্যায় জানে, তা তার কাছে বেঁচে থাকা। শুধু বেঁচে থাকার জন্যই বেঁচে থাকা। সে তো মেনেই নিয়েছিলো। কিন্তু সমাজ জেনে গেলে শুধু নিজের মেনে নেয়ায় বেঁচে থাকা যায় না। চিন্তায় বিপর্যস্ত সুধর রাতেই রহমতকে একা ফেলে বাড়ির পথ ধরে।
বাড়ির কাছাকাছি এসে আমগাছে ঝুলে থাকা চিত্রালীর দেহ আর নীচে পড়শীদের জটলাটা দেখতে পায় সে। নীচে থেকে অনেকগুলো মোবাইল ফোনের লাইট ঘুরে ঘুরে ঝুলতে থাকা দেহটার এখানে সেখানে নানা ভঙ্গিতে খেলছে।
কথাসাহিত্য
ছোটগল্প
বিশেষ সংখ্যা
মিথ | রুমা মোদক | ছোটগল্প | উৎসব সংখ্যা ১৪৩০
- June 11, 2023
- 0 Comments
- 340 Views
Leave feedback about this