তীরন্দাজ Blog লেখালেখি মাঝে মাঝে তব দেখা পাই | যশোধরা রায়চৌধুরী | লেখালেখি
লেখালেখি

মাঝে মাঝে তব দেখা পাই | যশোধরা রায়চৌধুরী | লেখালেখি

প্রথম পর্ব : ইস্তেহারের বিকল্পে

Write as you will
In whatever style you like
Too much blood has run under the bridge
To go on believing
That only one road is right.

In poetry everything is permitted.

With only this condition of course,
You have to improve the blank page.
(Young Poets/Nicanor Parra)

বাংলা আকাদেমির একটি অনুষ্ঠানে তারাপদ রায় একবার স্টেজ থেকে নেমে গিয়েছিলেন, কবিতাবিষয়ক একটি আলোচনায় দুটি মাত্র বাক্য বলে, ‘যে জিনিষটা নিয়ে কোন কবি কখনো একমত হননি তা নিয়ে আমি একটি বাক্যও খরচ করব না। বরং বাড়ি ফিরে দুটো হাসির গল্প লিখব, তাতে কিছু পয়সা ঘরে আসে। এও মনে রাখতে হবে, এই তারাপদ রায়ই ভূয়োদর্শী কিছু কবিতা অসম্ভব সহজ ভাষায় লিখে যেতে পারতেন, তাঁর একটি বইয়ের নামই ‘জলের মত কবিতা”। বোধ হয় ওই সহজতার কারণেই তারাপদ রায় কবি হিসেবে তাঁর প্রাপ্য জায়গাটুক বাংলা কবিতায় পেলেন না।

কীভাবে কবিতা লেখা হয় আমি জানি না। অথচ কবিতা লিখি। কী বিস্ময়!

কোন লিখিত পাঠবস্তু কখনো বা অকবিতা, কখনো তা যে কবিতা, তা আমি জানি। সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি, এই কথাটিও খুব বিশ্বাস করেছি একদা জ্যাজ বাজনার আপাত বেসুরে বাজা কর্ডগুলি যেভাবে সুরে বেজে ওঠে, সেই ধারণা যেমন বিমূর্ত কিন্তু ধ্রুবসত্য, তেমন নানান রকম সুরেই বেজে উঠতে পারে কবিতা, অন্তত পড়ে কবিতা বলে মনে হতেই পারে কোন আপাত অসংলগ্ন লাইনসমূহকে, এটা জানি। আসলে সত্যিকারের বেসুরো, আর আপাত বেসুরো কিন্তু সুরে সুরে বাঁধা, এই দুইয়ের ভেতরে ফারাক করতে পারি আমার নিজের মত করে। কে অধিকার দেয় আমাকে, কবিতার লেখক হতে? কে? হয়ত কবিতার লেখক হবার আগে কবিতার পাঠক হতে পারাটা জরুরি। আর সেটার জন্য থাকে আমাদের প্রস্তুতি, আমাদের পড়াশুনো, ব্যাকগ্রাউন্ড, আমাদের মনন, আমাদের শিল্পবোধ। হয়ত, অধিকার বলতে এটুকুই। নান্দনিকতার এইটুকু বোধ। একটা জানা, কবিতাকে হাড়ে তাকে জানা।

তবে এটা জানি, এই জানাটা থেকেও আমার কোন লাভ হয় না, কারণ কবিতা যে আমি লিখে উঠতে পারবই তার কোন গ্যারান্টি এই জানাটা থেকে পাওয়া যাবে না যুক্তিগ্রাহ্য কোন পদ্ধতিতে। না ইনডাকশন ডিডাকশন কোন পদ্ধতিতেই, কখনো।

বরং উল্টোটাই। এমন কি একটা কবিতা লেখার পরও, হয়ত আর কোনদিনই পরের কবিতাটি লিখে ওঠা যাবে না, এমন একটা শঙ্কা ওই জানাটা থেকেই আসে। যখন অন্যদের লেখা পড়ি। আর ঝিমিয়ে যাই। ভাল কবিতা, সত্যি কবিতা পড়ে ঝিমিয়ে যাই দুঃখে, যে এমন লেখা আমি লিখতে পারিনি আজও। অথবা চেষ্টা করে এমন লেখা লেখা যায় না। আর অন্যদিকে, খারাপ কবিতা, অ-কবিতা পড়ে ঝিমিয়ে যাই, কারণ বুঝতে পারি, আজও কবিতার নামে যা সব লেখা হচ্ছে তার অর্ধেক কবিতা হয়ে উঠছে না।

এ ক্ষেত্রে আমার এক নিকটজনের কথা বলি। যে বলেছিল, তুমি কবিতা লেখ জ্ঞান থেকে নয়, ইনস্টিংক্ট থেকে। আর এই একটি কথাই আমার সব কাজের ক্ষেত্রেই সত্যি। আমি রান্না করি ইনস্টিংক্ট থেকে, অফিসের কাজও করি ইনস্টিংক্ট থেকে।

লেখা একধরণের অভ্যেস আসলে। আর লেখার মধ্যে দিয়ে কিছু বলে ফেলা, ফেলতে চাওয়ার তাগিদ, তা একটা প্রবৃত্তিসুলভ অনিবার্যতা আমার কাছে। এটাকে যুক্তিগ্রাহ্য ভাবে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টাটাই আসলে ভুল হবে। আসলে, আমার কাছে আমার লেখা, বিশেষ করে কবিতা, এক ধরনের আরাম, মোক্ষণ অথবা নিষ্কৃতি বোধ। তা হয়ত-বা কখনো উৎসারিত হয় কবিতা সম্বন্ধে নান্দনিক বোধ থেকে (ছোটবেলায় ডায়েরিতে লিখতাম বার বার, সুন্দর হতে হবে আমায়, আমার সুন্দর হওয়া হচ্ছে না, আজ কোন সুন্দর মুহূর্ত এল না, আজ্ঞে হ্যাঁ, ছোট থেকে ডায়েরি লিখতাম আর সুন্দর হওয়া বলতে প্রসাধন মেখে আয়নার সামনে বসার কথা কিন্তু বোঝাইনি), কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিজের ভেতরকার অন্ধত্ব ও তাড়না থেকে, বেদনা থেকে। নিরুপায় এক ডিপ্রেশন ও অর্থহীনতা বোধ থেকে ছাড়া পেতে। কিছুটা, নিজেকে আশ্রয় দিতে।

এই তাড়না, যা আসলে এসেছে জীবনের নানা অভিশাপ ও না পাওয়া থেকে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে সেটাই তো আশীর্বাদ হয়ে উঠেছে, পাওয়া হয়ে উঠেছে। অন্তত কাগজের ওপরে কলম বুলিয়ে তাকে সাদা কাগজের থেকে একটু বেশি উন্নত কোন রূপ দিতে। নিকানোর পাররা, অ্যান্টি পোয়েট্টি মুভমেন্টের জনক; যেটা বলেছেন, উল্লেখ করেছি আগেই। কবিতা হবে অনেক রকম, কিন্তু সব শেষে, ‘ইট হ্যাজ টু বি অ্যান ইমপ্রুভমেন্ট অন দ্য ব্ল্যাংক পেজ’।

আনন্দ আর উৎসাহের বশে যে বয়সে মেয়েরা শাড়ির ডিজাইন আর ল্যাকমে মেবিলাইন-এর প্রসাধন নিয়ে ব্যস্ত থাকত আমার প্রজন্মে, আড্ডা আর লুডোখেলা, ব্যাডমিন্টন আর টিউশন পড়তে আসা অপরিচিত স্কুলবালক নিয়ে ব্যস্ত থাকত, কী এক অপরিসীম অন্তত্ব আর তাড়নার বশে সে বয়সে গাঁক গাঁক করে কেন যেন ডায়েরি লিখেছি আর কবিতার মত দেখতে কিছু একটা লেখার চেষ্টা করে গেছি। পড়েছি আমার বাবার, মৃত বাবার রেখে যাওয়া এক গোছা বই। সবচেয়ে ভাল লেগেছে সুভাষ মুখোপাধ্যায়, তারপর বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তারপর জীবনানন্দ দাশ। কারণ আমি অন্তত কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের আগে অব্দি, দীক্ষিতই হইনি জীবনানন্দে। রূপসী বাংলা বাদ দিলে বাকিগুলো কিছুই বুঝতাম না। প্রেমেন মিত্তির বুদ্ধদেব বসু, বাংলা মিডিয়ামের সূত্রে পৈতৃক সম্পত্তির মত পেয়েছি, কিন্তু ভাল লেগেছে অপেক্ষাকৃত সহজ নরেশ গুহ।

আমার কাকা মানস রায়চৌধুরীর বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে যুগ্ম বই বেরিয়েছিল যখন আমি স্কুলে। পারিবারিক সেই সব পলি, পরবর্তী প্রেসিডেন্সি অধ্যয়নের সময়কার দর্শন পাঠ, সার্ত্র, কামুর পলেস্তারা… সব মিলিয়ে হ্যাঁ, অনেক পেয়েছি জীবনে, আমার চালচিত্রে অনেক চুমকি রাংতা। হয়ত একটু বেশিই। অহংকার করার মতন বেশি।

কিন্তু শেষ অব্দি কেন কবিতা লিখব, তা এসব কিছুই নির্ধারণ করে কি? করে একটাই জিনিস। তাগিদ চাপ কষ্ট। আর সেটাই আমার মোটর। কবিতা আমি মন খারাপ থেকে লিখেছি, মন ম্লান হলে লিখেছি। এমনি এমনি লিখেছি (আমাদের ছোটবেলায় হরলিক্সের বিজ্ঞাপনে একটি বাচ্চা ছেলে বলত, আমি তো এমনি এমনি খাই…. সেই রকম বাঁধনহীন আনন্দে আর কি!)। মা বকলে লিখেছি, আর আমার স্বামীহারা একলা অসম্ভব গুণী খুব কষ্ট পাওয়া মা তো সারাক্ষণই বকতেন। প্রেমিক ছেড়ে গেলে লিখেছি, আর প্রেমিকরা তো কেবলি ছেড়ে যেত। এমন নিরানন্দ, গুমশে থাকা মেয়েকে কে আর ভালবাসবে। একের পর এক পর্ব, জীবনের, সেগুলো চলে গেলেও লিখেছি। জীবনের এই পর্বগুলোও তো যাবার জন্যই তৈরি হয়।

প্রথমদিকের কবিতাগুলি ডায়েরিতেই থেকে যেত। সেগুলিকে ছাপানোর কোন আশাই ছিল না। কোন দুরাশা, বলা ভাল। কারুকে পড়ানোর কোন ইচ্ছেও হত না। নিজেই পড়তাম। সেই গোপন ডায়েরিটি বড়ই যত্নে রাখা থাকত টেবিলের অন্য বইদের আড়ালে।

এর আগে কিছু সাফল্য এলেও বেশির ভাগটাই ব্যর্থতা। সাহস করে ছাপতে দিলাম, প্রেসিডেন্সি কলেজ ম্যাগাজিনে, প্রত্যাখ্যাত হল। ইতিমধ্যে একটি দুটি আন্তর্মহাবিদ্যালয় প্রতিযোগিতায় একটি দুটি প্রাইজ জুটেছে, সেগুলো সব সৃজনশীল গদ্য লিখে। তাতে মনের ভেতরে লেখক হবার আশা বেশ নতুন জল পাওয়া চারার মত ফনফনিয়ে উঠেছিল বটে। কিন্তু কলেজ ম্যাগাজিনে না অন্তর্ভুক্ত হতে পারার ধাক্কায় আবার নেতিয়ে পড়েছি। কলেজে যেসব বন্ধুরা খুব বড় কবি হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই তারা নিয়মিত জয় গোস্বামী, মৃদুল দাশগুপ্ত আওড়ায়, তাদের সঙ্গে আড্ডাও দিয়েছে। এসবই আমার কাছে অকল্পনীয়।

তারপর চাকরির পরীক্ষার দোটানা, নতুন জায়গায় কাজ করতে যাওয়া। একেবারে অন্য পরিবেশ নিজের টুকটাক ডায়েরি লেখার ফাঁকে ফাঁকে অক্ষরবৃত্তের লাইনগুলি লিখে লিখে রাখা।

যখন থেকে ছাপা শুরু হল (১৯৯৩) তখন লেখা সম্বন্ধে ঈষৎ পালটে গেল চিন্তাভাবনা। প্রথমে কালপ্রতিমা পত্রিকায় ছাপলেন বাসুদেব দেব। তারপর দেশ পত্রিকায় গৃহীত হল একটি কবিতা, সদ্য চাকুরে আমি সিমলার ট্রেনিং সেন্টারে বসে চিঠি পেলাম জয় গোস্বামীর। নিজের লেখার সঙ্গে নিজের সম্পর্ক পালটে গেল। অসম্ভব গোপনের জিনিস, অদ্ভুত লুকিয়ে রাখার জিনিস হঠাৎ পাবলিক হয়ে যাবার কষ্ট। বিচ্ছেদ, প্রথমটায়। হঠাৎ জনমানবহীন ছোট্ট ঘর থেকে বেরিয়ে এক বড় হলঘরে সবার সামনে নগ্ন হচ্ছি এমন একটা কষ্ট। প্রাইভেসি নষ্ট হবার শক।

ধীরে ধীরে সামলে উঠি সে সব। ধীরে ধীরে দাঁত, নখ, গজাল। অর্থাৎ একটা আলাদা কনফিডেন্স তৈরি হল বলা যায়। এর আগেকার কবিতা থেকে পালটে যেতে থাকল আমার ভাষা। নিজের পুরনো লুকনো ডায়েরির কবিতা লক্ষ্য করে, আমি দেখেছি, আমার লেখা-প্রবণতা ছিল খুবই শক্তি চট্টোপাধ্যায় অনুপ্রাণিত। এবং মাত্রাবৃত্ত ঘেঁষা। এটা বলছি ইস্কুলের, কলেজের সময়ের কথা, মানে ১৯৮২ থেকে ১৯৮৯ অব্দি। আসলে আমার বন্ধুবান্ধবদের মধ্যেও তখন বহু শাক্ত। শক্তিই কবিতার শেষ কথা। এই মাতোয়ারা ব্যাপারখানা ছিলই। আর ছিল জীবনানন্দ পড়ার অমোঘতা। কাজেই আমার নিজের কাব্য ভাষাও গড়ে উঠেছে জীবনানন্দীয় অক্ষরবৃত্ত মহাপয়ার আর শক্তির নিয়মভাঙা ভাষাব্যবহার, চটুলতা এবং কিছুটা ওই মাত্রাবৃত্তীয় ছকেই। পরে আমি মাত্রাবৃত্তকে প্রায় ছেড়ে দিই। পয়ারকে ধরে থাকতেই হয়, ওটা মাতৃস্তন্যের মত, এবং ওই দুগ্ধধারা কখনো শুকোবে না, আমৃত্যু পয়ার আমাদের আশ্রয় দেবে। কিন্তু আমার নব্বই দশকে লেখা যে কবিতাগুলো প্রথম জীবনানন্দ, শক্তি ও আরো পরে জয় প্রভাব থেকে (যা নিয়ে সবচেয়ে বেশি বেশি নিন্দিত হতে হয়েছে আমাদের প্রজন্মকে) মুক্ত হয়ে নিজস্ব ভাষা পেয়ে উঠছিল, সেগুলি কিন্তু অক্ষরবৃত্তেই লেখা।

এর সঙ্গে একটা সচেতন ব্যাপার যোগ হয়েছিল। তা শব্দ চয়ন বা ভোকাবুলারি সংক্রান্ত। নব্বইয়ের সময় বদলের সঙ্গে যার সংযোগ। এ নিয়ে আলাদা করে কাজ করার দরকার আছে। কারণ নতুন টেকনোলজি, রাজীব গান্ধির উদারীকরণ, টেলিকম বিস্ফোরণ সবকিছুর সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে, আমার, রাণার, জয়ন্তর, পিনাকির, রূপকের অনেক কবিতা। আমরা নিজেদের ভাষায় মুখের ভাষার কাছাকাছি আসার চেষ্টা করে চলেছিলাম। আমরা নিজেদের ভাষায় ইংরিজি ও হিন্দি শব্দকে সচেতনে অবাধ অনুপ্রবেশ দিচ্ছিলাম, আমরা নিজেদের ভাষায় টাটকা স্ল্যাং, পথের ভাষা, ঢের অপপ্রয়োগ, ঢের মজা, ইয়ার্কি, আর অনেক ভাংচুর ঢেলে দিচ্ছিলাম। ওটাও নিন্দার আর এক পর্ব। অনেক বড়, অগ্রজ কবি এ নিয়ে রীতিমত বকাবকি করেছেন, বিস্ময় ও জুগুপ্সা প্রকাশ করেছেন। তোমরা করছটা কি? তোমরা বাংলাকে আর বাংলা থাকতে দিলে না। এসে পড়ছে একটু একটু করে রেডিও, এফএম, ফোন, মেট্রো রেলের গহ্বর, টিকিট, চাকরি, বিনোদনের আঠাশ রকম সামগ্রীর নাম। এসে পড়ছে, টিভি, সিনেমা, এসে পড়াছে রাধা ও শ্যারন স্টোন এর তুলনা (শিবাশিসের কবিতা) এসে পড়ছে রবীন্দ্রসঙ্গীত বা গীতবিতানের কথাও (রূপকের কবিতা)। একটা দলবল তৈরি হল, তার একটা প্রতিফলিত কনফিডেন্সও ছিল হয়ত বা।

‘কবিতা লেখার প্রথম থেকেই ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হতো-যে-কোন লাইন থেকেই একটা কবিতা শুরু হতে পারে, আর যে-কোন লাইনেই শেষ হয়ে যেতে পারে সেই কবিতা। কবিতা হবে আপাত সরল। হাজারমুখো। বিষয়ের কোন বাছবিচার থাকবে না। আর কবিতার একটা লাইন থেকে আরেক লাইনের দূরত্ব হবে কয়েকশ কিলোমিটারের। কিন্তু অদৃশ্য একটা তলদেশে থাকবে মিলিমিটারের নিবিড় সম্পর্ক।
– ভাস্কর চক্রবর্তী

বিপদের এখানেই শুরু। যে মুহূর্তে নিজের হাতটার ওপর আত্মপ্রত্যয় আর অহংকার ভর করে, সে মুহূর্তে কবির লেখা নষ্ট হয় বলে মনে হয়, অন্তত তাই তো দেখেছি। যে সংশয়, যে আকুলতা, যে ছটফটানি, যে চার্জ থেকে কবিতার জন্ম, আত্মতুষ্টি আর আত্মপ্রতায় তার অ্যানাথেমা, বিপরীতমুখী তার টান।

ধ্বংসকারী মানুষের আশ্রয় যদি হয় কবিতার ভাষাবিদ, তবে বহির্বিশ্বের নির্মাণশীল সফলতা কি কবির ভাষাবিশ্বের পরিপন্থী? জীবনের প্রতিটি পর্বে এই প্রশ্ন এক একবার এক এক রূপে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়েছে।

আজকের আমি, আমার সামনে পাশে মাথার ওপরে ভন ভন করছে কাজ। প্রায়শই বহু বহু দিন ধরে কবিতা থেকে দূরে থেকে যাই। আবার এক অর্থে, রোজই কিছু না কিছু পড়া হয়, কথা বলা হয় কবিতা নিয়ে। তবু, জীবনযাপনের, প্রতি মুহূর্তের রুজিরুটির, সংসারের কাজ, এসবের মধ্যে কি সত্যিই হারিয়ে যাচ্ছে না আমার ধ্যান? নিজের কবিতার সঙ্গে নিজের নির্জন সহবাস সম্পর্ক? ঠিক ততটাই আমি কি সরে যাচ্ছি না কবিতার থেকে দূরে, সেই বিধ্বংসী অক্ষ প্রগাঢ় শান্তিময় আশ্রয়ের থেকে দূরে?

আমাদের কেউ বুঝতে পারে না। কবিদের। এই দুঃখ, অভিমান তালিসমানের মত পরে নিয়ে ঘুরি আমরা। সে তো ভাল, একদিক থেকে, আমরা তো মূলত কবি হয়েও, মানুষের ছদ্মবেশে ঘুরিফিরি, সংসারের আর পাঁচটা লোকের সঙ্গে মিশি ও কাজ করি। এভাবে ভাবলে, আমার ছদ্মবেশ বেশ পোক্ত। আমি ডেবিট ক্রেডিট মেলাই, আমি মেয়ের হোম ওয়ার্কে সহায়তা করি, আমি কাজের লোককে মাইনে দিই গুনে গুনে, আমি নিজের ডিএ বাড়ল কিনা সে খোঁজও রাখি, ফিক্সড ডিপোজিট ম্যাচিওর হলে তাও রিনিউ করাই।

এগুলো কবিদের করতে নেই? না এগুলো খুব ভালভাবে করলে কবিতার ক্ষতি হয়।

যদি এভাবে ভাবা যায়, যে এগুলো করলে আমাদের একটা বর্ম তৈরি হয়, আর সেই বর্মের আড়ালে আমরা রেখে দিতে পারি, আমাদের পুরনো সব অনন্য বোকামি। সামাজিকের মুখোশের আড়ালে রাখতে পারি মূর্খকে। যদি এভাবে ভাবা যায়, যে ওই সব কাজগুলো থেকে মন্থনে উঠে আসছে যে বিচ্ছিন্ন বিশ্রি বেসুরো আওয়াজ, ঘর্ষণে উঠছে যেসব বিষ, সেগুলোকেই তো আবার সাজিয়ে দেওয়া যায় কবিতার পাতায়!

আসলে তো তাইই। কবিতা স্বর্গীয় কিছুই নয়। আপতিক ও নিরুপায়। দুঃখময় ও ঐহিক।

মার্কিন গদ্যকার টেনেসি উইলিয়ামস বলেছিলেন, কোন গল্প তিনি লিখতেই পারেন না, যতক্ষণ না মূল চরিত্রটির প্রতি শরীরী আকর্ষণ অনুভব করেন। চরিত্রটি ছেলে হোক বা মেয়ে হোক, একটা তীব্র ইরোটিক অনুভূতি ছাড়া, লেখক লিখতে পারেন না সেই চরিত্রকে নিয়ে।

আমার কাছে টেনেসির ওই কথাটি ছিল অনেকদিন। তারপর বহু জল গড়িয়ে গিয়েছে। এই সেদিন আবার বেশ কিছু গল্প পড়ছিলাম বাংলার নানা রথী মহারথীর। ছোটগল্পের দুনিয়ায় আশ্চর্য সব কাজ হয়ে গিয়েছে আমাদের এই বাংলায়। সুবোধ ঘোষের কথা এই সূত্রে না বলেই নয়। আর গৌরকিশোর ঘোষ। এমন সেই টান, চোরাবৃত্ত, দুর্বারগতির কাহিনীবয়ন, বর্ণন আর পরিণতি এঁদের, এমন মিশেল মনন আর আবেগের, ইরোস আর র্যা শনালিটির। এঁদের রচনায়, জীবনবোধের ভাইটালিটিতে এমন ভরপুর আর আঁট হয়ে থাকেন এঁরা, এক একটা গল্প এঁদের যেন শুরু থেকে শেষ একটি রতিক্রিয়ার মত। ফোর প্লে থেকে শুরু করে ধাপে ধাপে উঠে যাওয়া অর্গ্যাজম পর্যন্ত।

নির্মাণের কিছু নিয়ম কানুনগত তফাত থাকলেও, আজকের দিনে আমি কবিতা, গল্প, উপন্যাস, গদ্য সবের ভেতর কোথাও এক অন্তর্গূঢ় মিল পাই। যে কারণে সিলভিয়া প্লাথের দ্য বেল জার উপন্যাস পড়লে, আমার মনে হয় তাঁর কবিতার টীকা পড়ছি, যেভাবে জীবনানন্দের মাল্যবান পড়লেও বুঝি সেই কথাটিই, যেটা আবার শঙ্খ ঘোষের কথা-র বিস্তারিত আকারও হয়ে যায়। একটাই লেখা সারাজীবন ধরে লেখেন এক কবি… এক লেখক।

বাকি যা থাকে তাও শারীরিক, ঐহিক। কিন্তু তা দক্ষতা বা ইনস্টিংক্টের অন্য দিক। লেখা মানেই একটা বিপুল শারীরিকতার ভেতরে থেকে যাওয়া। লেখার ভেতরে নিজেরই একটা শারীরিক পরিশ্রম আছে, একটা কসরত। পরিশ্রম না তো কি? ডানা টনটন করে, ঘাড় জমে যায়, চোখ জ্বালা করে। আবার সমস্ত শ্রম সার্থক বোধ হয়। পিঠ বেঁকিয়ে লিখে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে আমরা নিজেদের জন্ম সার্থক করি। কলম কাগজের ভেতরে বোধকে চালিয়ে দেওয়া বা কমপিউটারের কী বোর্ড টিপে টিপে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করার কসরত। নিজেকে ডিসিপ্লিনড রাখার কসরত। তা ছাড়াও বেশি কসরত বোধ হয়, নিজের ভেতর থেকে ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাওয়া কথাগুলোকে মাপমত কেটে কেটে বসাতে পারার দক্ষতা। যা ক্রমাগত একটা টানাপোড়েনের জন্ম দেয়। স্পিডের বাড়ানো কমানোর জন্ম দেয় আমাদের ভেতরে। এরপর, যদি লেখায় ভেতরের, একেবারে অন্তঃস্থলের কথাগুলি না-ই বললাম, তাহলে আর কি হল? এই ব্যাপারটা কিন্তু ভেবেচিন্তে হয় না, মেপে মেপে হয় না।

আসলে লেখাটাকে ঠিক ঠিক চ্যানেল দিয়ে চালিত করাটা একটা অভ্যেসের ব্যাপার। একটা খাল কেটে নিজের ভেতরের কুমিরকে বের করে দেওয়ার মত ব্যাপার, অনেকদিন ধরে একটু একটু করে অভ্যেসটা করতে হয়। জীবনবোধ, অভিজ্ঞতা, সেসবের দরকার যেমন থেকে যায়, যেগুলো আমার লেখাকে বডি দেবে, শরীর দেবে, ডিটেল দেবে, কাঠামো দেবে, অন্যদিকে ওই একটি জিনিষের প্রয়োজন থেকেই যায়। আমাদের কাছে তাগিদ বা চার্জ এখন সবচেয়ে দুর্লভ জিনিস। যা ছাড়া যে কোন সৃষ্টিকেই প্রাণহীন মাটির কাঠামোর মত মনে হয়।

সেই চার্জ, সেই বিষাদ, যা উজ্জ্বল ও আমার নিয়ন্ত্রণাধীন না একেবারেই। সেই কষ্ট যা ওপর থেকে নেমে আসে। কিন্তু অলৌকিক নয়, আপাত অলৌকিক হয়ত বা।

জয় গোস্বামী একবার বলেছিলেন, কোন এক বিখ্যাত ক্রিকেটারের কথা, যতদূর মনে হয় সুনীল গাভাস্কার, যতবার মাঠে ব্যাট হাতে দাঁড়াই, স্কোরবোর্ড শূন্যই থাকে, আবার একটা একটা করে রান করতে হয়। নিজেকে শূন্যের ওপর ছুঁড়ে দিতে হয় প্রতিবার, শূন্য ক্যানভাসের সামনে দাঁড়িয়ে সম্ভবত পাবলো পিকাসো এই কথাটি বলেছিলেন, উল্লেখ করেন জয়, অবশ্য কবিতার সূত্রেই উল্লেখটি ছিল, সেজন্যে মনে আছে আজও। এত সঠিক কথা হয়ত বা হয় না। ঐ অলৌকিক কি আবার নেমে আসবে আমার লেখায়? প্রতিটি নতুন কবিতা রচনার আগের মুহূর্তে হাঁ করে ড্যাবড্যাব করে শূন্য পাতাটার দিকে তাকিয়ে থেকে একথাই ভেবেছি, আহ শুকিয়ে গেছে অন্তরাত্মা। না-ও তো আসতে পারে সে!

অলৌকিকতার আর এক অন্য উপাদান বোধ হয় আছে কবিতার ভেতরেই। অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, সেই কবিতাটি লিখেই সবচেয়ে বেশি আনন্দ পেয়েছি যে আমার কাছে ‘আমার সৃষ্টি’, অথবা আমার নিয়ন্ত্রণাধীন মোটেই থাকেনি, স্বাধীন পাখনা পেয়ে নিজে নিজে দাঁড়িয়ে উঠেছে, বা নিজের অন্তলীন গতিবেগ পেয়ে দৌড়তে শুরু করেছে আমার তোয়াক্কা না করেই, ফলে যে কবিতা নিজে নিজে অনেকদূর গেছে আর আমাকে নিয়ে গেছে তার সঙ্গে ভ্রমণে। আমাকে যে কবিতা ক্রমশ উত্তেজিত করেছে, এবং পাহাড় নদী উপত্যকার দুর্গমতার চেয়েও অ্যাডভেঞ্চারাস ভ্রমণে আমাকে ঘুরিয়ে এসে নিজেই ক্লান্ত হয়ে থেমে গেছে কোথাও, কোন বিন্দুতে। সেই কবিতা, যে সবচেয়ে আন প্রেডিক্টেবল, অপ্রত্যাশিত খাতে বয়ে যেতে পারে, যে আমার ওপর একেবারেই নির্ভরশীল না, তার দেখা আমি পেয়েছি জীবনে অন্তত কয়েকবার কিন্তু বেশিবার নয়। তার আছে এক নিজস্ব ম্যাজিক। ম্যাজিক, যাকে অনেক সাধনা করেও পাওয়া যায় না। হারাই হারাই সদা ভয় পাই। হারাইয়া ফেলি চকিতে। মাঝে মাঝে যার দেখা পাই। চিরদিন কেন পাই না?

দ্বিতীয় পর্ব : ইস্তেহার

এতটা পড়ার পরেও যদি কারোর এই সদবুদ্ধি না জন্মে থাকে, যে এই তথাকথিত কবির আসলে কবিতার ইস্তেহার রচনার কোন অধিকারিত্বই নেই, এবং এর পরেও যদি তিনি আশা করে থাকেন একটি ইস্তেহার আমি তাঁকে উপহার দেব, তাঁর জন্য রইল একটি খসড়া ইস্তেহার, যার অধিকাংশই অগ্রজ কোন না কোন কবির থেকে হস্তলাঘবীকৃত।

১। কবিতা হবে জলের মত সহজ, জলের মত গভীর (সূত্র : তারাপদ রায় )
২। কবিতা হবে এমন, যা অন্তত সাদা পাতার মান উন্নত করে। (সূত্র : নিকানোর পাররা)
৩। কবিতা হবে সাদা পাতার সঙ্গে কবির কথোপকথন, প্রেম-প্রণয়, ঘৃণা-লড়াই সহবাস-সঙ্গম, বা যাবতীয় অন্যান্য কার্যকলাপ। থুতু, মল, মূত্রকেও সাদা পাতার ওপর রেখে তাকে কবিতা বলা হয়ে থাকে। এগুলো নিয়ে আমার শুচিবায়ু নেই, কেননা শেষত এই সবই জৈবনিক। (সূত্র : সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সাদা পৃষ্ঠা, তোমাকে’ ও পাসিং রেফারেন্সে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের একটি সাক্ষাৎকার, যেখানে তিনি এখনকার (তখনকার?) লেখালেখিকে ছেঁড়া চুল কাটা নখের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন।)
৪। কবিতা লেখা হতে পারে জীবনের, বেঁচে থাকার যা কিছু নিয়েই। যে কোন বিশেষ ও সাধারণ ঘটনাই কবিতার বিষয়। কবিতা কোন আশীর্বাণী বা জ্ঞান দেওয়া বা অনুশাসন বা ব্যাখ্যা নয়। কবিতা সমাজের কাজে লাগে না। তা পোস্টার নয়। তথাপি কবির প্রিঅকুপেশনে যদি একই ধরনের কবিতাই লেখা হয়, তাতেও আপত্তির কিছু থাকবে না, যতক্ষণ তা জীবন যাপনের সঙ্গে যুক্ত, সৎ এবং নিজেকে ক্ষমতাশালী না মনে করছে। (সূত্র: মেয়েদের কবিতা/ কালোদের কবিতা/ হরিজনদের কবিতা নিয়ে কিছু সমালোচকের শুচিবায়ুগ্রস্ততা (বিপরীত প্রস্তাব)
৫। কবিতা হবে ভাষা দিয়ে তৈরি। সেই ভাষা কেমন হবে তা কেউ বলে দিতে পারে না। ভাষা নির্ধারক কবি ছাড়া কেউ হবেন না। সমালোচকের কাজ কবির ভাষাকে ডিকোড করা, কেমন হবে তা বলে দেওয়া নয়। (সূত্র : তদেব)
৬। আমার কবিতা আমি লিখতে চাই এমন ভাষা দিয়ে, যা আমার রোজকার মুখে কথা বলবার ভাষার সবচাইতে কাছাকাছি। (সূত্র : আমার দশক, অর্থাৎ নব্বই দশকের লেখন প্রকল্প, যা ভাগ করে নিয়েছেন অনেকেই)
৭। আমার কবিতায় আমি রাখতে চাই নিজের কাতরতার চাবিকাঠি বা ম্যানুয়াল। নিজের সবটুকু সততা নিয়ে শুধু নিজের অভিজ্ঞতাই বলতে চাই। ‘সর্বজনীন’ হবার কোন দায় আমার নেই। তবে, অন্য কোন কাতর মানুষের ক্ষেত্রে ওই ম্যানুয়ালের একটি বিধিনির্দেশও যদি আনলক করে দেয় তাঁর নিজস্ব কোন অনুভূতিকে, সেটাই আমার সাফল্য হবে। (সূত্র : আমি)
৮। কবিতা খুলে দেবে সম্ভাবনার দরজা। তা নেবে নিজস্ব উড়ান। তার সঙ্গে কবির একটা দূরত্ব তৈরি হবে যে মুহূর্তে, সে আসলে কবির সৃষ্টি থাকবে না, উলটে কবিকেই নিয়ে যাবে একটা ভ্রমণে। কবির তোয়াক্কা না রেখেই সে নিজের পথ কেটে নিয়ে বেরিয়ে যাবে। কবি শুধু দুরুদুরু বক্ষে তার সঙ্গে সঙ্গে যাবে। (সূত্র : অসংখ্য কবিতা পাঠের অভিজ্ঞতা)
৯। প্রতিটি কবিতাই লেখা হয় একেবারে শূন্য থেকে। আগের কবিতাটি পরের কবিতাকে কোনভাবে প্রভাবিত করতে পারে না। (সূত্র : জয় গোস্বামী, সুনীল গাভাস্কার, পাবলো পিকাসো)
১০। প্রত্যেক কবি আসলে জীবনে একটিই কবিতা লিখে চলেন, সারা জীবন ধরে, নিজের বিভিন্ন লেখার মাধ্যমে। (সূত্র : শঙ্খ ঘোষ)

পাঠক, নয় এবং দশ নং যদি পরস্পরবিরোধী বলে মনে হয়, আমি নাচার। দুটিই চূড়ান্ত সত্য বলে প্রতিভাত। আর বিরোধাভাসের কথাই যদি ধরি, কবিতার ক্ষেত্রটিতে যত বিরোধাভাসের খোঁজ আপনি পাবেন তেমনটি আর কোথাও নয়।

উৎস : পরিকথা, পৌষ ১৪২১

Exit mobile version