বাংলাদেশ থিয়েটার
ক’দিন আগে আমি নকশাল আন্দোলন সম্পর্কে একটি নাটক লিখবার পরিকল্পনার কথা বলতে গিয়ে কথাপ্রসঙ্গে একজনকে মঞ্চের জন্য নাটক লেখার কিছু সীমাবদ্ধতার কথা বলেছিলাম। চলচ্চিত্রে চাইলে যেমন হাজার হাজার জনতাকে দেখানো যায়, নাটকে তা সম্ভব নয়। নাটকে চাইলেই গাড়ি, ঘোড়া, হাতি তুলে আনা যায় না, নাটকের ঘটনাকে সীমিত চরিত্রের মধ্যে বাঁধতে হয়। পঞ্চাশ বছরের ঘটনাকে তিন সাড়ে তিন ঘণ্টার মধ্যে আটকে রাখতে হয়। নাট্যকারকে অনেক কিছু ভাবতে হয়। ঠিক যেমন উপন্যাসিক লিখতে পারেন লক্ষ লক্ষ জনতার ভিড়ের কথা, নাট্যকার মঞ্চে তা দেখাবার কথা ভাবেন না। নাট্যকার চাইলেই সমুদ্রের মধ্যে জাহাজ ডুবে যাওয়া মঞ্চে দেখাবেন না, ফলে নাটক লিখবার সময়েই তিনি নানান সীমাবদ্ধতার কথা ভেবে গল্প সাজান। নাটকটা হয়তো কখনো মঞ্চস্থ নাও হতে পারে, কিন্তু নাট্যকারকে মঞ্চের সীমাবদ্ধতার কথা ভাবতেই হয়। নাটকটা তিনি পাঠ করার জন্য যেমন লিখতে পারেন, নাটকটা কখনো মঞ্চায়িত হোক তাও তিনি আশা করেন।
মঞ্চের এই সীমাবদ্ধতা নিয়ে প্রসঙ্গক্রমে ক’দিন আগে খুব সংক্ষিপ্তভাবে আমি একটি মন্তব্য করার পর, বাংলাদেশের নাট্যজগতের একজন সুন্দরভাবেই তার প্রতিক্রিয়া জানান। প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন: রাহমান চৌধুরী, সেটা নির্দেশক ভাববে। রচয়িতা কেনো প্রয়োগ নিয়ে ভেবে সংকুচিত হবেন? নাকি নাট্যকার নির্দেশিত নাটক -এর ফাঁদে আমরা দর্শক আটকে থাকবো? তবে, শুভকামনা জানবেন শ্রদ্ধেয়।
তিনি যে প্রসঙ্গটি তুলেছেন নানা কারণে আজকে সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। তিনি ইতিবাচক অর্থেই কথাটা বলেছেন। কারণ তার চিন্তা একইসঙ্গে আরো আনেকের চিন্তা। পাশাপশি এই চিন্তার কিছু খণ্ডিত দিক বা বিভ্রান্তিও রয়েছে। তিনি হয়তো বা বিভ্রান্ত নন। কিন্তু এ বিষয়ে প্রচুর বিভ্রান্তি এবং প্রচুর বিতর্ক আছে। স্বভাবতই তিনি যে প্রশ্নটি তুলেছেন, সেটা এড়িয়ে যাবার উপায় নেই। সেই কারণে তার মন্তব্যকে ঘিরে আমি আর একটু বিশদভাবে আমার বক্তব্য এক্ষেত্রে উপস্থাপন করতে চাই। কাউকে এটা বলতে চাই না, যা আমি বলবো বা আমার সব কথাগুলিই বেদ বাক্য। ইতিহাস কী বলে সেখান থেকেই আমি আলোচনাটা তুলতে চাই এবং তোলাটা দরকারও বটে। আমি আলোচ্য নাট্যকর্মীর মন্তব্যে সেদিন তাৎক্ষণিক একটি জবাব দিয়েছিলাম, আজকের আলোচনাটা সেখান থেকেই আরম্ভ করছি।
পৃথিবীতে কোন মহান নাট্যকার মঞ্চের সীমাবদ্ধতার কথা ভেবে নাটক লেখেননি? পৃথিবীর শুরু থেকে বড় বড় নাট্যকাররা যখন নাটক লিখেছেন এবং মঞ্চস্থ করেছেন, তখন নাটকের নির্দেশক বলে কিছু ছিলো না। নাটক রচনা এবং নাট্যচর্চা হচ্ছে আড়াই হাজার বছরের বেশি সময় ধরে। নাট্য নির্দেশকের দেখা পাচ্ছি আমরা তিনশো বছরের বেশি হবে না। ব্রেখটের নাটকের নির্দেশনা দিতে গিয়ে পৃথিবীর বহু নির্দেশকই গুবলেট করে ফেলেছিলেন। ব্রেখট তাই আগেই বলে গিয়েছিলেন, আপনি যদি মার্কসবাদী না হোন, মার্কসবাদে যদি আপনার আস্থা না থাকে আমার নাটকে হাত দেবেন না। পৃথিবীর শক্তিমান নির্দেশকদের প্রতি আস্থা এবং সম্মান রেখেই বলছি, নাট্যকারের নাটক নিয়ে নির্দেশকের স্বেচ্ছারিতাও মেনে নেয়া যায় না। নাট্যকারের নাটককে নির্দেশক নিজের ব্যক্তিগত মনোবিকার পূরণ করার কাজে ব্যবহার করবেন তা হতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম এসব হতে দেখা গেছে, এখন অনেকের নির্দেশনায় তা ঘটছে।
নির্দেশক কোনো ঈশ্বরের প্রেরিত পুরুষ নন। নির্দেশকের হাতে একটা নাটক কীভাবে ধ্বংস হয় বা দুর্বোধ্য হয়ে উঠেছে তাও আমরা দেখেছি। চেনা রবীন্দ্রনাথকে আর মঞ্চে গিয়ে চেনাই যায় না নির্দেশকের মহাপাণ্ডিত্যে। অল্পবিদ্যা সবসময় ভয়ংকর হয়, আর যদি সেখানে থাকে আত্মপ্রচারের অভিলাস তাহলে তো কথাই নেই। নির্দেশকরা কখনো কখনো নাট্যকারের নাটককে এমনভাবে কাটাকাটি করেন, সেখানে আর আসল নাট্যকারকে খুঁজে পাওয়া যায় না। নাটক এক সময় তিন ঘণ্টার হতো, পরে আড়াই ঘণ্টায় এসে দাঁড়ালো। নাটক এখন অনেকে দেড়ঘণ্টায় শেষ করতে চান দর্শকদের কথা মাথায় রেখে। নাটক দেড় ঘণ্টার হতেই পারে। কিন্তু নাট্যকারের তিনঘণ্টার নাটক দেড় ঘণ্টায় নিয়ে আসলে কী দাঁড়াবে?
বছর দুই আগে একটা নাটক দেখতে গিয়েছিলাম। বাইরের নাটক। নাটকটা খুব ভালো লাগছিল, তারপর হঠাৎ খাপছাড়া লাগতে থাকে। সেই নাট্যকার সম্পর্কে আমার ধারণা উঁচু, কিন্তু সেদিনের নাটকটা দেখে হতাশ হয়ে ফিরলাম। নাটকটা কেমন গোঁজামিল বা অপূর্ণ মনে হয়েছিল। পরে জেনেছিলাম, নাটকটা অনেক কাটাকাটি করা হয়েছে। ফলে নাট্যকার অন্যায় না করেও নির্দেশকের ত্রুটির কারণে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছেন যা কাম্য নয়।
কিছুদিন আগে আমরা একটা নাটক দেখতে যাই। বিদেশি নাটক অবলম্বনে মঞ্চস্থ। নাটকটার শুরুটা খুবই ভালো লাগে, মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম। যেমন নির্দেশনা তেমনি ছিল অভিনয়ের মান, বিশেষ করে অভিনেত্রীটি অসাধারণ অভিনয় করছিলেন। কিন্তু সামান্য পরেই নাট্যকারের বক্তব্য খাপাছাড়া লাগে, শুরুর সঙ্গে আর মিল খুঁজে পাই না। মনে হয় নাট্যকার স্ববিরোধী সব কথা বলছেন। নাটকের চরিত্রগুলো আর দাঁড়াচ্ছে না। বুঝতে পারি, নাটকের এই খাপছাড়া বক্তব্যে মূল চরিত্রটি আর দাঁড়াচ্ছে না। ফলে তার অভিনয় আর সাবলীল লাগছে না। অভিনেত্রীর চেয়ে আমি তখন দোষ দিচ্ছি নাট্যকারকে। নাটকটা খুশি মনে শেষ করতে পারলাম না। নাটক শেষ হলে আমার পাশের আমার বন্ধুকে নাটকটা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। দেখলাম সেও আমার সঙ্গে একমত। নির্দেশককে নাটক শেষে বললাম, নির্দেশনা ভালো, কিন্তু নাটকের বিষয়বস্তু নিয়ে আমার অনেক প্রশ্ন আছে।
নাটকটির অনুবাদককে পেলাম সেখানে, জানতে চাইলাম আপনি কি অনুবাদে কিছু পরিবর্তন এনেছেন? কারণ নাটকটির চরিত্রগুলি দাঁড়ায়নি এবং একমুখে নানা স্ববিরোধী সংলাপ শোনা গেছে। অনুবাদক হাসলেন আমার কথায়। বললেন, আসলে হয়েছে কি নাটকে পাঁচটি চরিত্র ছিলো। সেই পাঁচটি চরিত্রের নব্বই শতাংশ সংলাপ দু’জনের মুখে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ধাক্কা খেলাম আমি। অনুবাদককে বললাম, আমি আপনার মূল অনুবাদটা পাঠ করতে চাই। তিনি আমাকে তা পাঠালেন। নাটক পাঠ করতে গিয়ে আমি মুগ্ধ হলাম। মঞ্চস্থ নাটকের সঙ্গে তার অনেক ফারাক। মঞ্চের নাটকে অনেক যৌনবিষয় মূল নাটকে ছিল না। নাট্যকার সম্পর্কে আগের ভুল ভাঙ্গলো। নাটকের অনুবাদ ভালো ছিল, তবুও কয়েকটা প্রশ্ন মাথায় জেগেছিল। সে জন্য অনুবাদকের কাছে প্রশ্ন রাখলাম, নাটকের সব ঘটনা ইউরোপে ঘটছে, সেখানে বাংলাদেশের সাভার এলো কেমন করে? সেই রকম আরো দু-একটা প্রশ্ন। নাট্যকার বললেন, নির্দেশক চাইছিলেন যেন আমি দেশীয় ভাবধারায় নিয়ে আসি। আমি বিনীতভাবে বললাম, সেটা অনুবাদকের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। আপনি নাটকটা সরাসরি অনুবাদ করবেন। নির্দেশক দরকার হলে রূপান্তর ঘটাবেন। বিষয়টি নিয়ে সম্মানিত অনুবাদক এবং আমি একমত হলাম। নির্দেশকরা এভাবে অনেক সময় নাট্যকারের মূল বক্তব্য থেকে বহু দূরে সরে যান। তাতে নাট্যকার ভুল বোঝার শিকার হন। আজকাল বহু নাটকেই দেখি অকারণে যৌনতা নিয়ে বাড়াবাড়ি করা হয়। নাটকে খিস্তি আর গালাগাল আসে অকারণে। বহু সময় মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ নাটক লিখতেই জানতেন না, কারণ তার নাটকে খিস্তি নেই।
শম্ভু মিত্র রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী মঞ্চস্থ করেন, শুনেছিলাম সেটা নিয়ে বিশ্বভারতীর কিছু আপত্তি ছিলো। যারা নাটকটা দেখেছেন বা শুনেছেন, সবাই এ নাটক দেখে মুগ্ধ হবেন। সম্ভবত এ নাটকটি প্রথম আমি শুনেছিলাম ৭১ সালে, আকাশবানীতে। যখন এ নাটক নিয়ে পরে আপত্তির কথা শুনলাম, বুঝতেই পারিনি কেনো? কারণ নাটকটা তখনো পড়া হয়নি। নাটকটা শুনে সামান্য খাপছাড়া লাগেনি। কিন্তু পড়তে গিয়ে দেখলাম নাটক থেকে বাদ পড়েছে গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ। সেই অংশটা বাদ দেওয়াতে শ্রমিকদের ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ যে কতোটা আধুনিক ছিলেন শম্ভু মিত্রের রক্তকরবী শুনে তা বুঝতে পারিনি। শম্ভু মিত্র বাদ দিয়েছিলেন নাটকের একটা ছোট অংশ, সেখানে শ্রমিকদের সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের নতুন মনোভাবের দেখা পাওয়া যায়। সেই অংশটা পাঠ করলে বোঝা যায়, নাটকে কেবল রাজা আর নন্দিনী গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ শ্রমিকশ্রেণি। রবীন্দ্রনাথ এই নাটকের ভিতর দিয়ে তাদেরকে ভিন্ন আলোয় উপলব্ধি করেছিলেন। কিন্তু শম্ভু মিত্র নাটকটা সম্পাদনা করেছিলেন এমনভাবে, তাতে রবীন্দ্রনাথকে ভুল বুঝবার কিছু ছিলো না। নাটকটা শুনতেও খাপছাড়া লাগেনি। কিন্তু শ্রমিক প্রশ্নে ভিন্ন এক রবীন্দ্রনাথকে তাতে চিনতে পারা যায়নি।
নির্দেশনার প্রশ্নে যেমন সমালোচনার দিক আছে, প্রশংসা করবার বহু কিছু আছে। নির্দেশক নামের এক ব্যক্তির আবির্ভাব না ঘটলে বহু নামকরা নাট্যকারের নির্দেশনা আর হতো কি না সেটা একটা প্রশ্ন। পৃথিবীর বহু নির্দেশক নাটকের মান বাড়িয়ে দিয়েছেন। নির্দেশকরা কেবল গুবলেট করে সেটাই একমাত্র সত্য নয়। নির্দেশকদের প্রশংসা করবার মতন ঘটনা বরং অনেক। বড় বড় অনেক নির্দেশকরা এসেছেন বড় মাপের কাজ করেছেন। বহু আলোচিত নির্দেশক আছেন। যারা নির্দেশক হিসেবে অনন্য উচ্চতায় চলে গিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন পিসকাটর আর একজন পিটার ব্রুক। সকলেই তারা নিজেদের কর্ম দ্বারাই মহিমান্বিত। ভারতে শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্তের নাট্যচর্চার আরম্ভ নির্দেশক এবং অভিনেতা হিসেবে। নির্দেশকদের রয়েছে বিরাট ভূমিকা বর্তমান বিশ্বে নাটককে জনপ্রিয় করতে। মঞ্চের প্রভূত উন্নতিতে তাদের অবদান অসামান্য।
নাট্যকারের হাতে নির্দেশনার ভিতর দিয়েই বিশ্বের ইতিহাসে মঞ্চের জন্ম, আলাদাভাবে কোনো নির্দেশক এসে তখন মঞ্চ সৃষ্টি করেননি। নাটকের প্রথম পর্বে যখন নাটক ছিল পাঁচালী, তখন যিনি রচয়িতা তিনিই নির্দেশক, তিনিই অভিনেতা। নাটকের সেইসব ইতিহাস কি নির্দেশকদের বর্তমান বাস্তবতায় পাল্টে যাবে? নির্দেশকরা একটি বাস্তবতার প্রেক্ষিতেই নাট্যজগতে এসেছেন। নাট্যচর্চার তাতে লাভই হয়েছে। ক্ষতিও হয়েছে অনেক সময়। সেরকম ক্ষতি বর্তমান সময়ে নাট্যকাররাও করছেন। নাটকের নামে যা খুশি একটা কিছু লিখে বসে আছেন তারা। ভিন্ন দিকে অনেকে নিজে নাটক লিখে নিজে নির্দেশনা দিয়ে নাট্যচর্চাকে সব রকমভাবে কালিমালিপ্ত করেছেন। সত্যিকারের নির্দেশকরা এখনো নাট্যকার বেঁচে থাকলে নাটক নির্দেশনায় তার পরামর্শ নেন। নাটকটা যদি নাটক হয় এবং দক্ষ একজন নির্দেশক যদি তার মূলভাবটা ধরতে পারেন, তাহলে সফলতা না আসবার কারণ নেই। কিন্তু একজন নাট্যকার নাটক লিখবার আগে কী কী চিন্তা করবেন, কয়টা চরিত্র রাখবেন, কীভাবে নাটককে সাজাবেন সেটা সম্পূর্ণ নাট্যকারের স্বাধীনতা। সেখানে নির্দেশকের কথা আসবে কী কারণে?
নাট্যকার আগে, নাকি নির্দেশক আগে? নাটক লেখার পরেই নির্দেশক নাকি নাট্যকারদের এখন থেকে নির্দেশকের কাছে জিম্মি থেকে নাটক লিখতে হবে? যদি তা না হয়, নাট্যকারকে অবশ্যই মঞ্চের সীমাবদ্ধতার কথা মাথায় রাখতেই হবে। মঞ্চের সীমাবদ্ধতার কথা না ভেবে কি নাটক লেখা সম্ভব? প্রয়াত সেলিম আল দীন জীবনের শেষ দিকে এ নিয়ে ভিন্ন মত প্রকাশ করতেন। তিনি পাশ্চাত্যের নাট্যচিন্তার অনুসরণকে দাসত্ব বলতেন। তিনি নাটকে ধারাবর্ণনার এক রীতি আবিষ্কার করেন, যা সম্পূর্ণ তার নিজস্ব পদ্ধতি। তিনি কেরামত মঙ্গলের পর নাটক রচনার ক্ষেত্রে বামদিকে চরিত্রের নাম এবং ডান দিকে সংলাপ লেখাটা একেবারেই পছন্দ করতেন না। তিনি কেরামত মঙ্গলের পর বা আগে যেসব নাটক লিখেছেন, ঢাকা থিয়েটারে তা অন্যরা নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি ঢাকা থিয়েটারে কোনো নাটকের নির্দেশনা দিয়েছেন বলে জানি না। তিনি কেরামত মঙ্গলের পর যা লিখতেন তা হতো দীর্ঘ, সেগুলো সংলাপের আকারে লিখতেন না তিনি। কিছুটা তা গল্পের কাঠামো পেতো। তা মঞ্চস্থ হবার সময়ে আরেকজনকে আবার মঞ্চযোগ্য করে লিখতে হতো।
মঞ্চের আলেচিত অভিনেত্রী শিমুল ইউসুফ নিজেই আমাকে একদিন বলেছিলেন, সেলিম আল দীনের রচনাগুলিকে খুব কষ্ট করে আমাদের আবার মঞ্চ উপযোগী করে লিখতে হয়। কিন্তু আমরা যারা কষ্ট করে এই কাজটি করি, কখনো আলোচনায় আমাদের নাম বলা হয় না। ব্যক্তিগতভাবে আমি তার এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত। সেলিম আল দীনের পরের রচনাগুলিকে মঞ্চে আনার জন্য পুনরায় সময় ব্যয় করে সংক্ষিপ্ত আকারে লেখা হতো, যেগুলো আমার পাঠ করবার সুযোগ হয়েছে। তাতে যে কারো লেখা একটি উপন্যাসকে নাট্যরূপ দেয়ার মতন ঘটনাই ঘটতো। সেলিম আল দীনের ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম ছিলো না। ফলে সেই মঞ্চস্থ নাটকগুলোর জন্য সেলিম আল দীনকে কতটা নাট্যকার বলা যাবে তা নিয়ে আমার মনে নানা প্রশ্ন আছে। পরে সেসব নিয়ে বিস্তারিত লিখবো।
ঢাকা থিয়েটারের কাছ থেকে পাওয়া সেলিম আল দীনের রচনার নাট্যরূপগুলো দেখলে বোঝা যায়, মূলত সেলিম আল দীনের নিজের বক্তব্যের সঙ্গে তা বিরোধী। কারণ সেগুলোতে বামদিকে চরিত্রের নাম এবং ডান দিকে থাকে সংলাপ। মাঝে মাঝে আবার বর্ণনা। বিশেষ করে বনপাংশুলের নাট্যরূপটি যে কেউ দেখে নিতে পারেন। নাট্যরূপ বলছি এ কারণেই যে, মঞ্চের উপযোগী করে তা অন্যদের দ্বারা লিখিত। পাশ্চাত্যের নাটক লেখার ঢংয়েই এই নাট্যরূপগুলি তৈরি। তাহলে সেলিম আল দীনের বাম দিকে চরিত্রের নাম আর ডান দিকে সংলাপ লেখায় আপত্তির এতটা কারণ কী? বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক তৈরির আগে একটি কথা বলে রাখি, সেলিম আল দীন একজন নমস্য ব্যক্তি তার বিভিন্ন রচনার জন্য। ব্যক্তিগতভাবে তার প্রথম দিকের রচনার জন্য তাঁকে আমি নাট্যকার ভাবি এবং পরের দিকের রচনার জন্য কথাসাহিত্যিক। যে নামেই বলি না কেন, তার প্রথম দিকের কয়েকটি নাটক এবং শেষের দিকের কিছু লেখাকে আমি খুব গুরুত্বপূর্ণ লেখা বলে বিবেচনা করি। সেগুলো যতটা না মঞ্চস্থ করার উপযোগী, তার চেয়ে অনেকবেশি পাঠযোগ্য।
বাংলাদেশে সেলিম আল দীন পাঠ হয়েছে অনেক বেশি, সেই তুলনায় মঞ্চস্থ হয়েছে কম। বর্তমানে সেলিম আল দীনের নাটকের মঞ্চায়ন কমে গেছে। কালে ভদ্রে মঞ্চস্থ যা হয়, সাধারণ দর্শক কতটা তা গ্রহণ করে সে প্রশ্নটা রয়েই যায়। কিন্তু তাতে তার রচনার সাহিত্য মূল্য কমে যায় না, নাট্যমূল্য প্রশ্নসাপেক্ষ। কারণ মঞ্চের জন্য সেসব লিখবার সময় তিনি মঞ্চের সীমাবদ্ধতার কথা ভাবতেন না। কিন্তু অন্যরা সেই সীমাবদ্ধতা মাথায় রেখে নাট্যরূপ দিতেন। দৃশ্যকে বর্ণনার ভিতর দিয়ে রূপ দেয়ার চেষ্টা রয়েছে সেখানে। তার রচনাগুলি আরো বহুকাল পাঠ করবে মানুষ। কারণ সেগুলি পাঠের একটি আনন্দ আছে। কতটা মঞ্চ উপযোগী তা নিয়ে ভবিষ্যতে হয়তবা গবেষণা হতে পারে। কিন্তু এখনো তার লেখার কিছু পাঠক আছে। যদিও ফেসবুকের কারণে শোনা যাচ্ছে, পৃথিবীতে গ্রন্থপাঠ করার লোক দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। ভিন্ন দিকে বাংলাদেশে গত চল্লিশ বছরে পাঠকই কম দেখা গেছে। বই বিক্রি এবং গ্রন্থাগারগুলোর দিকে তাকালে তা প্রমাণিত হবে। ফেসবুক আসার আগেই এখানে পড়ার অভ্যাস মানুষের সংখ্যা কম ছিল। নাটক পাঠ করার লোক ছিল আরো কম।
বাংলাদেশেই একটা কথা শুনতে পাই, নাটক পাঠ করার বিষয় নয়, নাটকের সার্থকতা মঞ্চে। পাশ্চাত্যে কখনো এরকম কথা শোনা যাবে না। কারণ নাটক সেখানে পাঠ করার বিষয়। নাটক পাঠ ছাড়া সাহিত্য পাঠ শেষ হয় না। ইবসেনের এনিমি অব দ্য পিপল প্রথম বারো হাজার কপি ছাপা হয়েছিল সেই যুগে যখন জনসংখ্যা অনেক কম ছিলো। নাটকটির বারো হাজার কপি ছাপা হয়েছিল নাটক মঞ্চায়নের কথা ভেবে, নাকি নাটক পাঠ করার কথা ভেবে? নাটকের পাঠকদের জন্যই তা করা হয়েছিল। নাটক হচ্ছে বিশ্বের প্রাচীন সাহিত্যের একটি। কিন্তু বাংলাদেশের নাট্যজগতে নাটকের পাঠক নেই। নাট্যকর্মীরা ক’জন বিশ্বের বা নিজের দেশের কয়টা নাটক পাঠ করেছেন এই প্রশ্ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের বহু নামকরা নাট্যব্যক্তিদের বা নাট্যকর্মীদের নাটক বা নাটকের বই পড়তে দিয়ে দেখা গেছে? তারা তা পড়েন না। নাটক না পড়েও তারা নাট্যজগতের লোক! পাশ্চাত্যে মানুষ সাহিত্য পড়তে গিয়ে নাটক পাঠ করেন। নাটক সবসময় সেখানে দেখার ব্যাপার না।
বিশ্বে বহু মানুষ আছেন যারা শেক্সপিয়রের সব নাটক পড়েছেন সাহিত্য ভেবে কিন্তু কখনো কোনো শেক্সপিয়রের নাটকের মঞ্চায়ন দেখেননি। যখন আমরা পাশ্চাত্যের বহু নাটক পাঠ করি, তার সব মঞ্চায়ন দেখার সৌভাগ্য তো আমাদের হয় না। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য পাঠ করতে গিয়ে বহু শিক্ষার্থী নাটক পাঠ করে কিন্তু কখনোই হয়তো মঞ্চে কোনো নাটক দেখেনি। এরকম বহু শিক্ষার্থীর কথা আমি জানি। নাটক পাঠ করে সেই সব শিক্ষার্থীরা, তা নিয়ে পরীক্ষার খাতায় বহু কিছু আলোচনা করে। কিন্তু নাটকটির মঞ্চায়ন কখনো দেখে না। কিন্তু নাটকটির সামাজিক ভূমিকা তা নিয়ে তাদেরকে লিখতে হয়। নাটকের একটা বিশেষ দিক আছে রাষ্ট্রের প্রেক্ষিতে। কয়েকটি নাটক মঞ্চায়নের আগেই অনেক দেশে সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ হয়েছিল। মিডিয়া নাটকটি লেখার জন্য গ্রিসের মানুষ ক্রদ্ধ হয়েছিলেন নাট্যকারের উপর। কারণ নাটকের ঘটনায় ছিলো, মা তার শিশু সন্তানকে পুড়িয়ে মারছে। সেটা নাগরিকরা সেই যুগে পছন্দ করেনি। নাটক কখনো একটা বিদ্রোহের নামান্তর। ফলে নির্দেশক ছাড়াই নাট্যকারের নাটকের আরো বিরাট ভূমিকা থাকে।
সন্দেহ নেই, নাটক যখন মঞ্চায়িত হতে আরম্ভ করে তখন নাটক লেখাই হয়েছে মঞ্চায়নের কথা ভেবে। নাট্যকারই তখন নাট্য নির্দেশনাসহ সব দায়িত্ব পালন করতেন। নাটক তখন বিনোদন ছিলো না। সে যুগে নাটক ছিলো শিক্ষা, বিশেষ করে পাশ্চাত্যে। ভরতের নাট্যশাস্ত্রেও নাটককে শিক্ষার মাধ্যম বলা হয়েছে। প্রাচীন গ্রিসে নাটকের মাধ্যমে বিভিন্ন দর্শন, রাজনীতি বা চিন্তা প্রকাশ করা হয়েছে। সকল মহৎ সাহিত্য বা নাটকই তাই। সত্যিকারের নাটক যখন আবির্ভূত হলো, নাট্যকারকে সে যুগের নানা সীমাবদ্ধতার কথা ভেবেই নাটক লিখতে হয়েছে। প্রাচীন মিশরে একধরনের নাটক হতো তিন চারদিন ধরে। কখনো রাস্তায়, কখনো রাজপ্রাসাদে সে নাটক মঞ্চায়িত হতে দেখা গেছে। জনগণ বা দর্শক মঞ্চায়িত নাটক দেখার জন্য সেই প্রদর্শীত নাটকের পেছনে পেছনে তিনদিন ধরেই হেঁটে বেড়াতেন। নাটকের প্রদর্শনী বন্ধ থাকার সময়টায় তারা নিজের একান্ত ব্যক্তিগত কাজগুলো করতেন। সেই প্রদর্শীত নাটকে কাউকে হত্যা করার দৃশ্যে সত্যিই সত্যিই মানুষকে হত্যা করা হতো। কারণ তখন হত্যা করার জন্য ক্রীতদাসদের নির্বিকারভাবে বেছে নিতেন নাটকের সঙ্গে যুক্ত মানুষরা। কিন্তু নাটকের ইতিহাসে সেগুলোকে পূর্ণাঙ্গ নাটক না বলে, নাটকের প্রস্তুতি পর্ব হিসেবে বলা হয়েছে। ঠিক যেমন পাঁচালী বা গ্রিসের মন্দিরের একক অভিনয়, সেগুলো কখনো পূর্ণাঙ্গ নাটকের মর্যাদা পায়নি। মানুষের মধ্যে এই বোধদয় হলো, নাটক প্রাচীন মিশরের মতন তিনদিন ধরে চলতে পারে না। এরকম হলে চলবে না। সময়ের সঙ্গে মানুষ বুঝতে শিখলেন শিল্পকলা বা নাটককে হুবহু বাস্তব করে তোলা যাবে না প্রাচীন মিশরের সেই নাট্য প্রচেষ্টার মতন। সেগুলো উৎসব হতে পারে, নাটক নয়। প্রাচীনকালের বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবের মধ্যেই নাটকের গুণ লুকিয়ে ছিলো। নাটক হিসেবে সেগুলো স্বীকৃতি পেলো যখন কালের বিবর্তনে তার মধ্যে চরিত্র এলো, বিভিন্ন বার্তা প্রচারিত হলো এবং তা কতিপয় মিলনায়তনের সুনির্দিষ্ট দর্শকশ্রোতার উদ্দেশ্যে তা মঞ্চস্থ হলো।
বহু ধারাবাহিকতার ভিতর দিয়ে, মন্দিরের পাঁচালীর পথ বেয়ে একদিন বর্তমান সময়ের নাটক মঞ্চে এলো। সে নাটকের প্রধান ব্যক্তি নাট্যকার বা কবি। গ্রিসে তখন নাট্যকারদের কবি বলা হতো। এরিস্টটল তাই তার নাট্যতত্ত্বের গ্রন্থের নাম রাখেন ‘পোয়েটিকস’। সেখানে আলোচনা হয়েছে নাটক নির্দেশনা বা তার অভিনয় নিয়ে নয়, পুরো আলোচনাটাই নাট্যকার বা নাটক নিয়ে কিংবা বলা যায় নাটকের বিষয়বস্তু নিয়ে। তিনি নাটকের মধ্যে যে ছয়টি বৈশিষ্ট থাকার কথা বলেছিলেন। তার চারটি হলো: গল্প বা আখ্যান, চরিত্র, সংলাপ এবং নাটকের বার্তা। এরিস্টটলের লেখায় প্রধান হয়ে ওঠে নাটক কীভাবে মঞ্চস্থ হবে তা নিয়ে নয়, বরং নাটক রচনা কেমন হবে তাই নিয়ে। তারপর বহু বছর বলতে গেলে দু হাজার বছর নাটকের আলোচনায় গুরুত্ব পেয়েছেন নাট্যকার এবং নাটকের বিষয়বস্তু। নির্দেশক বা অভিনেতাদের আলোচনা বা প্রসঙ্গই সেখানে নেই। বরং গুরুত্ব পেয়েছে নাট্যকারের নাটক কতটা সমকালীন, কতটা সমাজের পক্ষে কিংবা কতটা রাষ্ট্রবিরোধী। উনিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত তাই লক্ষ্য করা যায়।
কার্ল মার্কস প্রচুর নাটক নিয়ে আলোচনা করেছেন, আর তার পুরোটাই হলো নাট্যকারদের নাটকের বিষয়বস্তু। বহুল জনপ্রিয় শেক্সপিয়রের নাটকের নির্দেশক তার সময়কালে কে ছিলেন? তিনি নিজেই। নাটক তখনো দিনের আলোতে খোলা আকাশের নিচে মঞ্চস্থ হতো। মার্লো নিজেই নিজের নাটকের নির্দেশক। বর্তমান সময়ের মতন পোষাক, রূপসজ্জা, আলোর ঝলকানি ছাড়া সেইসব নাটক ছিল এতটাই জনপ্রিয় যে, নাটকের টাকায় নাটদলের সকলের সংসার চলতো। সাড়ে তিনঘণ্টার নাটক দেখতে হতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। কিন্তু নাট্য মঞ্চয়নকে মানবসভ্যতায় প্রযুক্তি আগমনের সঙ্গে সঙ্গে সামনে এগিয়ে যেতে হয়েছিল। নাটকে নির্দেশক আসলেন বাস্তব প্রয়োজনে। ইস্কাইলাস, সফোক্লিস, ইউরিপিডিস, শেক্সপিয়র প্রমুখ বেঁচে নেই, কিন্তু তাঁদের নাটক তাহলে মঞ্চায়িত হবে কীভাবে? যিনি এই নাটক মঞ্চায়নের দায়িত্ব পেলেন বা দায়িত্ব নিলেন তিনিই হলেন নির্দেশক। কারণ কবর থেকে ইস্কাইলাস, সফোক্লিস বা ইউরিপিডিসকে তুলে আনা যাবে না। কিংবা স্বর্গে গিয়েও তাঁদের খুঁজে পাওয়া যাবে না। যা ভেক নাটকে দেখিয়েছিলেন বা রূপায়িত করেছিলেন নাট্যকার এরিস্টোফানিস।
সত্যিকার অর্থে এরিস্টোফানিসের ‘ভেক’ রচিত হয়েছ সুচতুর কৌশলে। সেখানে নাটক নিয়েই নাটক আরম্ভ হয়, নাটকের মধ্যে নাটক হতে থাকে, আবার রাজনীতিও সেখানে উঠে এসেছে। নাটকের মূল বার্তায় সেখানে কেমন হওয়া উচিত বা কেমন হয় সেই প্রসঙ্গটি গুরুত্ব পেয়েছিল। সবচেয়ে বড় বিষয় এই নাটকটি ছিলো এরিস্টোফানিসের পূর্ববর্তী তিন বিখ্যাত নাট্যকারের মূল্যায়ন, যার মধ্যে সফোক্লিস এবং ইউরিপিডিসের নাটকের চরিত্ররা এবং নাট্যদর্শন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। নাট্যকাররা সবাই সেখানে কবি হিসেবেই চিহ্নিত, যা অর্থ দাঁড়ায় সেই যুগে কবি না হলে নাট্যকার হওয়া যেত না। শেক্সপিয়রের সময়কালটাও প্রায় তাই ছিলো। সস্তা সংলাপ বা যা কিছু লিখেই তখন নাট্যকার হওয়ার সুযোগ ছিল না এবং দর্শককে ধরে রাখতে না পারলে নাট্যকারের মৃত্যু ঘটতো সেখানেই। কী অস্ত্র দিয়ে দর্শককে ধরে রাখতেন সে যুগের নাট্যকার? নাটকের গল্প, চরিত্র এবং সংলাপ দিয়ে। নাটকটাই সেখানে প্রধান। নাটকের পোষাক, আলো বা আবহসঙ্গীত নয়। নিশ্চয়ই অভিনয়ের খুবই গুরুত্ব ছিলো সেই সঙ্গে। সত্যি বলতে নাটকের সংলাপটাই সবার মধ্যে অগ্রণী, সংলাপটাই আসলে নাটক। সংলাপের ভিতর দিয়েই নাটকের চরিত্রগুলি এবং গল্প নির্ণীত হয়। আর কিছু নয়। ধারা বর্ণনার কোনো প্রয়োজন নেই সেখানে। বিশ্বনাটকে তা আজও প্রয়োজন হয়নি। কারণ বর্ণানাত্মক ব্যাপারটাই ছিল পাঁচালীর সঙ্গে যুক্ত, সে জন্যই তা পাঁচালী বা বর্ণনা বা গল্প। যখন নাটকে চরিত্র এলো, দুই বা ততধিক চরিত্রের মধ্যে নানা সংলাপের ভিতর দিয়ে দ্বন্দ্ব আরম্ভ হলো, তখনই বলা নাটক। নাটকের আলোচনায় আজকেও তাই দ্বন্দ্বটাই প্রধান। নাটকের সংলাপই এই দ্বন্দ্ব তৈরি করে। ভারতীয় নাটকে সেখান সংলাপের সঙ্গে ছিল সঙ্গীত। ধারা বর্ণনা ভারতীয় নাটকেও নেই, আছে চরিত্রসৃষ্টি।
নাটক কতটা রাষ্ট্রবিরোধী এই আলোচনা শুরু প্লাটো থেকে। এরিস্টটল সেখানে পোয়েটিকস লিখে বলতে চেয়েছেন নাটকটা যেন রাষ্ট্রবিরোধী না হয়। ফলে নাট্যকার প্রাচীন রাষ্ট্রে এবং মধ্যযুগেও ব্যক্তি হিসেবে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন। নির্দেশক বা অভিনেতারা তখনো আলোচিত নন। নাট্যকাররা খুব আলোচিত কারণ, সবাই তখন নাটক লেখার জন্য কলম নিয়ে বসে যেতেন না। নাটকের নামে তাই আবর্জনা রচিত হতো কম। দ্বিতীয় কারণ নাটকটা টিকে থাকে যুগের পর যুগ একটি গ্রন্থ বা প্রকাশনা হিসেবে। কিন্তু মঞ্চস্থ নাটকের আয়ু তখন ক্ষণকালের। চলচ্চিত্র আবিষ্কারের আগে পর্যন্ত সেটাই ছিল সত্য। নাট্যকার যখন জীবিত নেই তখন নাটকটা মঞ্চায়ন করতে চাইলে নাটকের একজন নির্দেশক দরকার হবে। নাট্যকার জীবিত থাকতেও সেটা হতে পারে। নাট্যকার সবসময় নির্দেশনা দিতে চান না। কিন্তু সত্যিকারের একজন নাট্যকার নিজের নাটকের নির্দেশনা দিতে চাইবেন সেটাই খুব বেশি লক্ষ্য করা গেছে। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপট ভিন্ন। নাটকটা একসঙ্গে বহু জায়গায় মঞ্চস্থ হতে পারে। নাট্যকারের তখন আর নির্দেশনা দেয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু তারপরেও নাট্যকার হলেন নাট্যকার, নির্দেশক হলেন নির্দেশক।
নির্দেশকের উপর ভরসা করে নাট্যকার কখনো নাটক লেখেন না, লেখা সম্ভব নয়। সত্যিকারের একটি নাটক একই সঙ্গে নাটক এবং সাহিত্য; সেই সঙ্গে তা রাষ্ট্র ও সমাজের দর্পণ। কখনো কখনো সেই সঙ্গে একটি কবিতা। নাট্যকার নিজের পরিকল্পনা এবং ধ্যান ধারণার উপর দাঁড়িয়ে স্বাধীনভাবে ঠিক করবেন মঞ্চের নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যে তা কীভাবে রচনা করা যায়, যা দর্শককে টানটান উত্তেজনার মধ্যে ধরে রাখবে। নাটক রচনা শেষ হওয়ার পরেই তা মঞ্চায়নের পরিপ্রেক্ষিতে আসবে একজন নির্দেশকের কথা। কথাগুলো সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিগত অনুধাবন। এ নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা চলতে পারে।
রাহমান চৌধুরী : নাট্যকার ও নাট্য-গবেষক
Leave feedback about this