‘লেখকদের লেখক’ সতীনাথ ভাদুড়ী ‘জাগরী’র ছত্রে ছত্রে অসাধারণ এক কাব্য রচনা করেছেন। ভাব ও ভাষার ছন্দবন্ধনে মোড়ানো এই অমর জীবনকাব্য ব্রাত্য পাঠকের অনুভূতিকে সম্পূর্ণ মোহময় ও অবশ করে তোলার জন্য যথেষ্ট। ২৭ সেপ্টেম্বর সতীনাথ ভাদুড়ীর জন্মনি উপলক্ষে এই লেখাটি প্রকাশিত হলো।
১
বহুবছর পর জাগরী’র সাথে রাত জাগা হলো। অস্থির সময় আর মন নিয়ে বিষয়টা আমার জন্য কঠিন ছিল। তবে জাগরী পাঠে ঢোকা যত কঠিন, বেরিয়ে আসা তারচেয়েও কঠিন। সাধারণ এক পাঠক হিসেবে আবার সেই সত্যটারই মুখোমুখি হলাম।
এক রাজনৈতিক পরিবারের চার সদস্যর জীবনের বিশেষ এক সন্ধ্যা থেকে সকাল। পূর্ণিয়া সেন্ট্রাল জেলে ভোররাতে ফাঁসির অপেক্ষায় সি ডিভিশনের আসামি বিলু, আর সেই চরম খবর পাওয়ার অপেক্ষায় আপার ডিভিশন রাজবন্দী পুরুষদের সেলে বিলুর বাবা, নারীদের সেলে বিলুর মা আর জেলগেটে দাদার মরদেহ গ্রহণের জন্য অপেক্ষারত নীলু। ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান থেকে এক অভিন্ন উদ্বেগ আর আশঙ্কায় চারজনের আত্মকথনই আপাতদৃষ্টিতে জাগরী’র সমগ্র কাহিনি। যা নির্দিষ্ট সময়কালকে অনায়াসে অতিক্রম করে বৃহত্তর সময় ও সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশে পাঠককে নিয়ে যায়।
বিলুর বাবা এক সরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক পদের নিশ্চিন্ত জীবন ছেড়ে দুই ছেলে, স্ত্রীসহ গান্ধী সেবাশ্রমে আশ্রয় নেন। পুরো পরিবার খাদ্যাভ্যাস ও জীবনাচারে কঠিন কৃচ্ছসাধনের মধ্যে অভ্যস্ত হয়ে যায়। আশ্রমের সকাল-সন্ধ্যা প্রার্থনা থেকে শুরু করে গান্ধীর মতাদর্শ অনুসরণে সকলেই দেশসেবক হয়ে ওঠে। অর্থের অভাবে বিলুর উচ্চশিক্ষা গ্রহণ সম্ভব হয় না। বিলুর চেষ্টায় নীলু যদিও পরবর্তীতে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করে। ছেলেদের শৈশব কৈশোরের যা কিছু আদর¬আবদার তা একমাত্র মায়ের সাথে। আশ্রমের হাড়ভাঙা খাঁটুনির মধ্যেও সেটুকুই ছিল বিলুর মায়ের আনন্দভুবন। গান্ধী আশ্রমে মাছ -মাংস খাওয়ার সুযোগ ছিল না। জ্যেঠিমার বাড়ি ছিল ওদের আর এক আশ্রয়। তিনি ওদের মাছ-মাংস রান্না করে খাওয়াতেন। বিলুর মায়ের তাতে আপত্তি ছিল না। আপত্তি ছিল জ্যেঠিমাকে বিলুর মা ডাকে। মাতৃত্বের এতটা ভাগ দিতে তিনি রাজী ছিলেন না।
ছোট থেকেই দুই ছেলে স্বভাবে ভিন্ন মেজাজের। বিলু ধীরস্থির শান্ত। বাবার মতই কর্তব্য ও আদর্শের ক্ষেত্রে কঠিন, অনমনীয়। নীলু একগুঁয়ে, চঞ্চল, মেজাজী। যা চাই, তা তাৎক্ষণিক জয় করে পাওয়া চাই। নীলুর নিত্যনতুন কাণ্ড সামাল দেওয়া তার মায়ের জন্য কঠিন ছিল। নীলুকে সবসময় আগলে চলতো বিলু। দাদা ছিল তার সার্বক্ষণিক আশ্রয়। দুজনের সম্পর্ক ছিল অভিন্ন আত্মার।
বাবার আদর্শবাদের অন্ধ অনুসরণ থেকে প্রথম বিলুই নীরবে সরে আসতে শুরু করে। সকাল-সন্ধ্যার কীর্তন ভজনের মাধ্যমে প্রার্থনায় অংশ নেওয়া বন্ধ হয়। মা বিস্মিত হন। বাবা কথা বলেন না। ১৯৩০-৩২-এ জেলখানায় এসে বিলু-নীলু যোগ দেয় কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টিতে। বাবার রাজনীতির আদর্শ থেকে তাদের পথ পৃথক হয়ে যায়। সোশ্যালিস্ট হওয়া বিলুর বাবার কাছে সময়ের ফ্যাশন মাত্র। বিলুকে বাধা দিলেই কান টানলে মাথা আসার মতো নীলুও বাধা পেত। বাধা দেননি বিলুর বাবা, “বিলু হইল বয়স্ক ছেলে, আর তাহাকে করিতে যাইব শাসন? আমার মতের সহিত মত মেলে নাই বলিয়া? তাহার ব্যক্তিত্বের এতটুকু সম্মান যদি না রাখিতে পারি, তাহা হইলে আমার মতের সংযম ও সহনশীলতা থাকিল কোথায়?” নিজের চারিত্রিক সংযম রক্ষার ক্ষেত্রে তিনি রীতিমতো শুচিগ্রস্ত বটে। মশারি ব্যবহার করেন না। কৃচ্ছতাসাধনের সহিষ্ণুতা প্রমাণের জন্য।
নীলুর রাজনৈতিক জীবনে বিলু “কেবল সহকর্মী নয়, কেবল কমরেড নয়, ও যে আমার দাদা। কত সুখদুঃখের স্মৃতি বিজড়িত একসূত্রে গাঁথা আমাদের জীবন। “কিন্তু কোনো কিছুতেই দাদার কোনো অভিযোগ না থাকাটা দাদার প্রতি নীলুর বড় অভিযোগ, “তাহার রক্ত যেন গরমই হয় না। বুদ্ধিশক্তির তীক্ষ্ণতা ও অনুভূতির তীব্রতা থাকা সত্বেও, আবেগের উগ্রতা ও প্রাণশক্তির প্রচণ্ডতা উহাদের মধ্যে নাই।” পক্ষান্তরে প্রচণ্ড আবেগ আর উত্তাল প্রাণশক্তিতে নীলু ভরপুর। দাদার পক্ষপুটের নিরাপদ আশ্রয়-প্রশ্রয় নীলুকে ক্লান্ত করে। ১৯৪০-এ দুই ভাই পুনরায় একসাথে জেলে থাকে। এইসময় কম্যুনিস্ট পার্টির এক নেতার বক্তব্য নীলুকে নতুন প্রাণ দেয়। মনে হয়, দাদা আর সে যে রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত তা রুগ্ন, সুবিধাবাদী, নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভাবপ্রবণতার উচ্ছ্বাসে পূর্ণ। সর্বহারার মুক্তি এই পথে হতে পারে না। এই মনে হওয়া মুহূর্তেই বিশ্বাসে পরিণত হয়। তাছাড়া রাজনৈতিক জগতে পৃথক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র পরিচিত হয়ে ওঠার তাগিদটা এতই প্রবল হয়ে ওঠে যে দাদাকে না বলেই নীলু কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য হয়। হঠাৎ নীলুর সাবালকত্ববোধ প্রশ্ন জাগায়, “রাজনীতির ক্ষেত্রে নাবালকত্ব কি চিরকালই থাকিয়া যাইবে?”
এদিক থেকে নীলুর মতামতের প্রতি বিলুও তার গান্ধীবাদী বাবার মতো সহনশীলতার প্রশ্নে অনড় থাকে। দুই ভাইয়ের এতদিনের একসাথে চলার পথ বিভক্ত হয়ে যায়। নিতান্তই সৌজন্যসূচক কথাবার্তা ছাড়া নীলুর সহজ মেলামেশার সংকোচবোধ বিলুর দৃষ্টি এড়ায় না। পারতপক্ষে সেও নীলুকে এড়িয়ে চলে। নীলুর এই সংকোচের বড় কারণ, দাদা নয়, সে নিজেই। পার্টির কাছে তাকে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে হবে, “আমার সর্বদা ভয় যে আমার পার্টির লোকেরা আবার কী মনে করিবে? দাদা যে প্রতিদ্বন্দ্বী দলের নামজাদা কর্মী। উহার সহিত অন্তরঙ্গতা আমার পার্টির লোকেরা নিশ্চয়ই পছন্দ করিবে না।” এই বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠার সংকোচ নীলুকে সবসময়ই তাড়িত করে বেড়ায়।
বিয়াল্লিশের অসহযোগ আন্দোলন – ভারত ছাড় আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের রাজনৈতিক জগৎ উত্তাল হয়ে ওঠে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে কেন্দ্র করে কম্যুনিস্ট পার্টির বিভিন্ন অংশ এইসময় সরকার বিরোধী সন্ত্রাসী কার্যক্রমের বিপক্ষে দাঁড়ায়। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে তা ফ্যাসিবাদের হাতকে শক্তিশালী করবে বলে পার্টি নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এবং অনিয়মতান্ত্রিক গণআন্দোলনের প্রকাশ্যে বিরোধীতা শুরু করে। এর জেরেই বিলুর নেতৃত্বে রেললাইন উপড়ানোসহ অন্যান্য নাশকতামূলক কাজে আটক বিলুর বিরুদ্ধে নীলু প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য দেয়। বহু মহলের বহু চাপ ছিল এই সাক্ষী না হওয়ার জন্য। কিন্তু ব্যক্তি সম্পর্ক যাই থাকুক না কেন, রাজনীতিতে “আমি নীলু আর সে দাদা নয়।” সে তার বিপরীত মতাদর্শের অনুসারী। তাছাড়া “রাজনৈতিক মতবাদের কথা ছাড়িয়া দিলেও বোধহয় আমার ব্যক্তিগত জিদের প্রশ্নও আসিয়া পড়িয়াছিল।” কোনো চাপের কাছে নত না হওয়া নীলুর আশৈশবের জিদ। কিন্তু অবচেতনে পার্টির কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠার অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার আর একটা প্রচেষ্টাও কী কাজ করে নাই এক্ষেত্রে? কিন্তু দাদার বিরুদ্ধে এই সাক্ষ্যদান তার নিজ পার্টির বিচারেও সঠিক হয় নাই জেনে নীলু আশাহত ও বিড়ম্বিত হয়। নীলুর সাক্ষ্যের গুরুত্বেই বিলুর ফাঁসির হুকুম হয়। সাক্ষী দেওয়ার সময় বন্যজন্তু ছাড়া তাকে কেউ ভাবে নি। কুত্তা কাঁহাকা বলে আওয়াজ দিয়েছে অন্য আসামি। বন্ধু বা অন্যরা তাকে ঘৃণায় এড়িয়ে গেছে। বেনামি চিঠি এসেছে, কোনোটা হুমকি, কোনোটা ঘৃণা, কোনোটা পিতৃপরিচয় নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে। মুখরোচক গল্পও বাদ যায় নি যে, দুই ভাই এক সরস্বতীর প্রেমে পড়ে হিংসার চরিতার্থ রূপ এই সাক্ষ্যদান। একা নীলু জানে, তার রাজনৈতিক বিশ্বাস ব্যক্তিপরিচয়ের অনেক ঊর্ধ্বে। সেখানেও গভীরতর বিশ্বাস একমাত্র দাদা তাকে ভুল বুঝবে না। কল্পচোখে দেখে দাদার মরদেহ ঘিরে প্রশাসনের নিষেধ অগ্রাহ্য করে শত শত জনতার শোকস্তব্ধ মৌন মিছিল। সেই মিছিলে “আছে একটি রাষ্ট্রীয় পরিবারের একজন ছাড়া অপর সকলের প্রতি অপরিসীম সহানুভূতি।” সেই একজন আর কেউ নয়, নীলু নিজে। বলা যায় না, জনতার এই সুপ্ত দেশাত্মবোধের ধিক্কার ভস্মের শীতলতা থেকে বেরিয়ে হঠাৎ তাকে টুকরো টুকরো করে ফেলতে পারে। এত ঘৃণা নিয়ে পূর্ণিয়া থাকা আর সম্ভব হবে না। কিন্তু জনমতকে এড়ানো বা “জনমতকে তাচ্ছিল্য করা চলে। কিন্তু মার অব্যক্ত বেদনাভরা দৃষ্টিকে, জ্যাঠাইমার নীরব ভৎর্সনাকে উপেক্ষা করা চলে না। “কী করবে নীলু? আর তো মাত্র কিছু সময়। নিজেকে নিজে সান্ত্বনা দেয় এইভাবে যে, সমাজের যুগ যুগান্তের সঞ্চিত অশ্রু মোছানোর দায় কাঁধে নিয়ে ভেঙে পড়লে চলবে কেন? সারা পৃথিবী তার বিরুদ্ধে গেলেও সে নিজেকে নিজে জানাতে চায়, সে ভুল করেনি।
নীলু ভুল করেছে। ভাইয়ের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়ে ভাইকে ফাঁসিতে ঝুলানোর আদেশ পার্টির নীতিসঙ্গত বুঝে উঠতে নীলু ভুল করেছে। এই ভুল উপলব্ধিতে এলে সারাজীবন নীলুকে অনুতাপদগ্ধ হতে হবে। বিলুর বাবা সেটা চান না। তিনি খুব ভালোভাবে জানেন, যতই মনের জোর থাকুক, যুক্তির ন্যায্যতা নিয়ে ছেলের মনে যখনই সন্দেহ জাগবে তখনই সে ভেঙে পড়বে, “নীলু, ভগবান করুন, তুমি কোনদিন যেন তোমার ভুল না বোঝ। কেননা উহার উপর ভর দিয়াই তুমি এখনো দাঁড়াইয়া আছ।” নীলুর বিরুদ্ধে এর বেশি ক্ষোভ বা তিরস্কার নেই অভিজ্ঞ ও দূরদর্শী পিতার। আপার ডিভিশন রাজবন্দী হিসেবে সেলে বিলুর বাবার যথেষ্ট সুযোগ সুবিধা রয়েছে। সারাজীবন কঠিন আদর্শনিষ্ঠ মানুষ হিসেবে তিনি পরিচিত। সর্বতোভাবে চেষ্টা করছেন তাঁর দুর্বলতা, অস্থিরতা, যন্ত্রণা কাউকে বুঝতে না দিতে। ডাক্তাররা হাসুক, সোশ্যালিস্টরা অবিশ্বাস করুক, চরকা কাটতে বসলে স্নায়ু উত্তেজনা কমে, এটা তাঁর জীবনে পরীক্ষিত। আজ শুধু একা নন, অন্য সাথীরাও চরকা নিয়ে বসছেন তাঁর সাথে। সুতো ছিঁড়ে যাচ্ছে। ভজনের সুর বেসুরো হয়ে যাচ্ছে বারবার। পুত্র শোকাতুর সুরজুবল্লীর পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন একসময়। আজ সেই হাত ফিরে এল তাঁরই কাঁধে। সহানুভূতির স্পর্শ হয়ে। নিজেকে কঠিন প্রমাণ করার সংযম মুহূর্তেই চূরমার হয়ে গেল। গান্ধীজির নামেও আর শান্তি হচ্ছে না। বাবা হিসেবে, স্বামী হিসেবে নিজেকে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে জীবনের খতিয়ান মেলানোর চেষ্টা করছেন। বিলু, নীলুর এই পরিণতির জন্য নিজেকেই দায়ী মনে হচ্ছে। শিক্ষকতা ছেড়ে পরিবারের সবাইকে নিয়ে দেশসেবায় নেমেছেন। ভেতরে ভেতরে চিরকাল শিক্ষকই রয়ে গেছেন। ছেলেদের সাথে কখনো বন্ধু হিসেবে মেশেননি। তাতে শাসন করা শক্ত হয়ে যায় এমন বিশ্বাস থেকে। নিজের জন্য সমীহ আদায়ের এই চেষ্টাটা ছিল সব ক্ষেত্রেই, “রাজনীতির ক্ষেত্রেও বড়কে গুরু, ছোটকে শিষ্য মনে হয়েছে। কমরেড হতে পারেননি” কোনোক্ষেত্রেই। গান্ধীবাদের মাধ্যমে দেশে রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা হবে। গীতার আদর্শ ঘরে ঘরে ধ্বনিত হবে। এটা তাঁর বিশ্বাস।
বিলুর শেষ সময়ের শান্তির জন্য গীতা পাঠান তাঁর পক্ষ থেকে। গীতা বা অন্যকিছু তার লাগবে না সুপারকে জানিয়ে দেয় বিলু। বাবা হিসেবে তাতে তাঁর আত্মপ্রসাদ তৈরি হয়, “আমার নাম উজ্বল করিয়া, সকল প্রকার হীনতায় পদাঘাত করিয়া গৌরবোজ্জ্বল মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি লইয়া নন মিলিট্যান্ট বিলু চলিয়া যাইবে।” এই অহংকার কিছু সময় পরেই হাস্যাস্পদ মনে হয়, “যাহার উপর পিতার কর্তব্য করি নাই, সেই পুত্রের কৃতকর্মের অংশ লইতে আমার মন কুন্ঠিত নয়।” একধরনের ধিক্কার জাগে নিজেকে নিয়ে। চিরকাল সংসার উদাসীন মানুষটা এক ভয়ংকর রাতের মুখোমুখি হয়ে নিজেকে বিলুর মামার ভাষায় “পারফেক্ট ভ্যাগাবণ্ড” মনে করেন। বিয়ে করে স্ত্রী-সন্তানের উপর দায়িত্ব কর্তব্য যথাযথ পালন না করাটাও অপরাধ মনে হয়।
বিলুর মায়ের অমতের জন্য সরস্বতীর সাথে বিলুর বিয়ে হয়নি। না হওয়াই হয়তো ভালো হয়েছে। আর একটা মেয়ের কপাল পুড়ত। এতদিনে বিলুর বাবা উপলব্ধি করেন বিলুর মায়ের “রাজনীতির বন্ধুর ক্ষেত্রে আসা নিছক বানভাসির মতো। তাহার স্বাভাবিক ক্ষেত্র একটি ঘরকন্নার সংসার,নিবিড় সুখে ভরা, অতি দরদের সহিত নিজ হাতে গড়িয়া তোলা। যে গৃহপ্রাচীরের মধ্যে বাহিরের কোন বাত্যাবিক্ষোভ পৌঁছায় না, যে গৃহপ্রাচীর অনপলব্ধ জগতকে সীমায়িত, প্রত্যক্ষ ও নিশ্চিত করিয়া দিয়াছে তাহাই ছিল তাহার কাম্য। “এই সত্যটা বুঝতে না পারার বড় কারণ” বিলুর মার সহ্য করিবার শক্তিকেই আমি উৎসাহপূর্ণ সম্মতি বলিয়া ভুল করিয়াছিলাম।” আজ তাই ভয়, বিলুর মাকে নিয়েই। এই আঘাত কীভাবে সহ্য করবেন? পাহাড়সম উচ্চতায় লালিত এতদিনের ধৈর্য-সহ্য, আসন্ন পুত্রবিয়োগ কাতর চিত্তকে ভরে তুলেছে আত্মগ্লানিতে, “অনেক জানোয়ার নিজের সন্তান খাইয়া ফেলে, আমি কি তাহাদেরই দলে?” বিলুকে তিনি সম্মান করেন। বিলুর জন্য প্রার্থনা একটাই অন্তিম মুহূর্তের আগে সে যেন তিলে তিলে না মরে। কর্তব্যজ্ঞান তাঁর ছেলেদের অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেছে। সেটাই বোধহয় যথার্থ গীতার কর্মযোগ উপলব্ধি যা নাস্তিক পুত্ররাই সঠিক বুঝেছে, “ঈশ্বরে বিশ্বাস আমাদের মনে বল আনে, আর ঈশ্বরে অবিশ্বাস ইহাদের মনে দুর্বলতা আনে না।”
২
দেরিতে হলেও বিলুর বাবার বিলুর মাকে সঠিক মূল্যায়নে সক্ষম হন।। ধর্মপ্রাণ সাধারণ পতিব্রতা এক বাঙালি নারী। ছেলেদের সম্পর্কে তার কোনো অনুযোগ নেই। লুসি জমাদারনি যখন প্রশ্ন করে, “বাঙালি মাঈজি, তোমাদের কি অনেক জোত জমি, মবেশি (গরু মহিষ) অনেক আছে নাকি?” লজ্জায় কুঁকড়ে ওঠেন বিলুর মা। বৈষয়িক স্বার্থ নিয়ে তার ছেলেদের কোনো দ্বন্দ্ব নেই। দাদা অন্তঃপ্রাণ নীলু স্বেচ্ছায় নয়, পুলিশের জুলুমে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য হয়েছে এটাই বিশ্বাস। এখন তাঁর অনুযোগ নিজের ভাগ্য-ভগবান আর স্বামীর বিরুদ্ধে। ছোটবেলায় কঠিন অসুখ হতে বিলু বেঁচে ওঠে, “ভগবান, যদি ওকে নেওয়ার ছিল তখন নিলে না কেন? কেন আমার লোভ বাড়িয়ে দিলে?” ছেলেরা একটা বয়স অবধি দারুণভাবে ঈশ্বরবিশ্বাসী ছিল। সেই বিশ্বাস কেন নষ্ট হলো? কেন হিন্দুস্তানি মেয়ে ভেবে সরস্বতীর সাথে বিয়েতে তিনি মত দিলেন না? কেন জ্যেঠিমার বিলুর প্রতি অতিরিক্ত ভালোবাসা তার মাতৃত্বের অহংকারে আঘাত করত? জেল থেকে বেরোতে পারলে নীলুর হাত ধরে অন্যত্র চলে যাবেন। বিলুর বাবার কথা আর মানবেন না। সারাজীবন বিনাপ্রশ্নে স্বামীকে মেনে চলেছেন। চরম মুহূর্তে সকল সঞ্চিত ক্ষোভ নিয়ে প্রশ্ন, “তুমি দেশের স্বাধীনতার জন্য সব ছেড়েছ সত্যি, কিন্তু আমাকে তো একটুও স্বাধীনতা দেও নি?” স্বামীর কথামতো গান্ধীবাদে বিশ্বাসী হয়ে নিজের উপাস্য সব দেবতা ছেড়েছেন। ঠাকুর দেবতা ঘাটাতে যেয়ে আজ তার এই দুর্দশা, “গান্ধীজি, তুমি আমার একি করলে? তুমি আমাদের একেবারে পথের ভিখিরি করে ছেড়েছ?” নিজের গায়ের মাংস নিজের ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। বিলু যেন তাঁর কথা ভেবে কষ্ট না পায়, “তুই এখন মনে কর যে তোর মা তোকে একটুও ভালোবাসত না।”
কিন্তু মায়ের মুখ বারবার স্পষ্ট হয়ে ওঠে বিলুর সামনে। মাকে সে মা’য়ের শৈশব থেকেই মুখস্থ করে রেখেছে। মায়ের কষ্ট বুঝতে পারে বিলু। বাবা নিজেকে সামলাতে পারবেন। মা পারবেন কিভাবে? আর এক মাতৃমূর্তি জ্যেঠিমা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। অবচেতনে মনের মধ্যে জায়গা করে নেওয়া সরস্বতীও দূরে সরে না। সবচেয়ে ঘুরেফিরে আসে নীলু। নীলুর কথাই সঠিক। দাদা ছাড়া তাকে আর কে বুঝবে? কিন্তু যে নীলু দাদা বলতে অজ্ঞান তার ব্যবহারে সৃষ্ট ক্ষত বিস্মৃতির মলমে বা যুক্তির প্রলেপে কিছুতেই ঢেকে রাখা সম্ভব হয় না। চোখের সামনে ভেসে ওঠে নিজের পরিণতি, “একটি লোহার horizontal এ আমার মৃতদেহটা ঝুলিতেছে। পা দুইটি শূন্যে দুলিতেছে।” সহস্র গ্রহ উপগ্রহ কক্ষ্যচ্যুত হয়ে বিলুর প্রতি রোমকূপে, প্রতি স্নায়ুতে আলোড়ন সৃষ্টি করে। অতি মানবীয় সত্তার আবরণ ধরে রাখা শেষ অবধি সম্ভব হয় না, “নীলু! নীলু! তুই একি করলি?” গরাদ চেপে দাঁড়িয়ে পড়ে বিলু।
জাগরীর এই চার চরিত্রের মধ্যে বিলুর মা আমাদের নিত্য পরিচিত। বিশুদ্ধ আদর্শবাদ বিলুর বাবা, বিলু, নীলু প্রত্যেকের মধ্যেই সক্রিয়। অতি আদর্শবাদ লালন করার অহংবোধ থেকে বিলুর বাবা আর বিলুর ভেতরকার চিরকালীন মানবসত্তার প্রকাশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নীলু সেখানে নিজেকে রাজনৈতিক বিশ্বাসের জগতে আপোষহীন ব্যক্তি প্রমাণে সচেষ্ট। কিন্তু একে অনেকটাই আরোপিত মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। নিজেকে উচ্চতায় তুলে ধরার অতি মানবীয় আকাঙক্ষা অস্পষ্ট থাকে না। বিলু অনেক চেষ্টা করেও নীলুর ব্যবহারের ক্ষত ভুলতে পারে না। যথার্থই প্রশ্ন জাগে, “নিজের পার্টির প্রতি একনিষ্ঠতা দেখাইবার জন্য সহোদর ভাইয়ের ফাঁসির পথ সুগম করিয়া দেওয়া হৃদয়ের সততার প্রমাণ না রুগ্ন মনের শুচিবায়ের পরিচয়?” নীলুর বাকি জীবনের অবধারিত আত্মগ্লানির হাত থেকে অতি নাটকীয় ভাবেই, অলৌকিক ভাবেই অঘোরবাবুর সাথে কথোপকথনে জানা যায়, বিলু-সহ সাবোটেজের জন্য ফাঁসির দণ্ডাজ্ঞা প্রাপ্তদের অন্য সকলের আদেশ মওকুফ হয়েছে। আর ভোর রাতে যার ফাঁসি কার্যকর হয়েছে, সে অন্য আসামি, বিলু নয়। বাকশক্তিহীন হয়ে যায় নীলু। নতুন সূর্যের ঝলমল আলো জীবনকে এনে দেয় অন্যমাত্রা। প্রকৃতপক্ষে নীলুর জীবনের জন্য এই অপ্রত্যাশিত মুহূর্ত সবচেয়ে বেশি আশীর্বাদ হয়ে দেখা দেয়।
এক রাষ্ট্রীয় পরিবারের চার সদস্যর এই আত্মকথনের মাঝ দিয়ে আরও অনেকগুলো চরিত্রের পরিচয় পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে জ্যেঠিমা, নীতিশের মামী, সহদেব দুই ভাই, সরস্বতী, দুবেজি তার স্ত্রী, জেলখানার বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন সাথী, তেলীর বউ আরও অনেকে। ছড়ানো ছিটানো এইসব চরিত্রের কোনোটাই অনাবশ্যক নয়। কাহিনির রাজনৈতিক, সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক চেতনাপ্রবাহকে একমুখী ও গতিশীল রাখতে অল্প-বিস্তর সকলের ভূমিকাই উল্লেখযোগ্য। সকলে মিলেই জাগরীর ক্যানভাসকে বিচিত্র রঙে রঙিন করে তোলে।
আমাদের চিরচেনা পৃথিবীর মধ্যে জেলখানা আর এক বৈচিত্র্যময় পৃথিবী। নানা কর্মের দায়িত্ব ভার নিয়ে ব্যস্ত নানা ধরণের কর্মচারী-কর্মকর্তা। সবাই সবাইকে হিসেব করে চলে। বেতন থেকে সকলেরই উপরি অর্জন চারগুণ। কয়েদিদের পরিজন থেকে, কয়েদিদের থেকে, তাদের জন্য বরাদ্দকৃত সকল দ্রব্যাদি থেকে নিয়মমত চুরি চলে, ভেতরে নানাবিধ ব্যবসা চলে। এসব ব্যবসার সাথে নানা শ্রেণির কয়েদিরা,কতক রাজবন্দীরাও যুক্ত থাকে। কেউই এককভাবে এসব কাজ করতে পারে না, “জেলের আভ্যন্তরীণ শাসনতন্ত্র এমন যে যতক্ষণ শৃঙ্খলের সকল বলয়গুলি সংযুক্ত না হইতেছে, ততক্ষণ চুরির যোজনা সফল হইতে পারে না। খাও, কিন্তু মিলিয়া মিশিয়া খাও।” যন্ত্রের মতো ঘণ্টা পার করা, গুনতি মিলানোর মাঝেও নানা ঘটনা ঘটে। বন্দীদের পর অত্যাচার নিত্যদিনের ব্যাপার। উপর শ্রেণির রাজনৈতিক নেতাদের নানা কারণে সাধারণত কেউ ঘাটাতে চায় না। ডাক্তার-কমপাউণ্ডার-হাসপাতাল জেলখানার আর এক বিচিত্র দিক। হৃদয় নিয়ে জেলখানার এই বিচিত্র জগতে সকলেরই মাথাব্যথা কম। তার মাঝেও কিছু মানবিক অনুভূতি স্পর্শ করার মতো।
শুধু জেলখানা নয়, রাষ্ট্র, রাজনীতি, রাজনীতিবিদদের চরিত্র জাগরীতে নানাভাবে উঠে এসেছে। অসহযোগ আন্দোলন এবং স্বদেশী আন্দোলনের তুঙ্গ মুহূর্তে কংগ্রেস এবং অন্যান্য দল ক্ষমতার ভাগাভাগিতে উন্মত্ত হয়ে ওঠে। যুগ যুগ সঞ্চিত জগদ্দল পাথরের নিচ থেকে জনশক্তির উত্তাল জোয়ারকে হিসেব করে সবাই। “তখৎ ইয়া তখতা” – সিংহাসন অথবা ফাঁসি – নিক্তির এপাশ আর ওপাশ। দেশ-বিদেশের প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সাথে সংঘর্ষ, উপদলে উপদলে, ব্যক্তিতে-ব্যক্তিতে, জাতিতে-জাতিতে সংঘর্ষ রাজনীতির নিষ্ঠুর নিয়ম, “সবাই আগে চলিয়াছে, পিছনের লোক পড়িল কি মরিল তাহা ফিরিয়া দেখিবার দরকার নাই।” রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন অংশ অর্ধপ্রস্তুত কাঁচামালের মতো সবসময় চলমান। সর্বত্রই রাষ্ট্রদানবের নগ্নতা ও বর্বরতা। রাজনীতিবিদরা এর মধ্যে “Crush or be crushed” – নিজ গতির গর্বে মহাব্যস্ত। চাকার নিচে নিশির ডাকে আবিষ্ট জনতার মধ্যে কোথায় কোন হতভাগা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়, তা নিয়ে কারো বিন্দুমাত্র আগ্রহ নাই। শ্রেণিস্বার্থের স্টিম রোলার সর্বত্রই সচল।
শুধু রাজনৈতিক পরিবেশ নয়, ভারতের সামাজিক জীবনের হাজার বছরের অস্পৃশ্যতা, জাতপাত বিভেদ বেশ শক্তভাবেই উপন্যাসে উঠে এসেছে। সি ক্লাসের নারী-বন্দী মনচনিয়ার মুখে বামুনের মেয়ে হয়েও পা টেপার কাজের আক্ষেপ, মাঘাইয়া ডোমীর হরিশ্চন্দ্র বংশের লোকের গর্ব, বিলুর মার মেথরকে হরিজন বলা, ছেলেদের সাথে তাদের ছেলেদের খেতে দেওয়া, সরস্বতী হিন্দুস্তানি বিধায় বিলুর সাথে বিয়ের প্রস্তাবে রাজি না হওয়া, বাহরগামিয়া সম্প্রদায়ের ছোঁয়া কুয়োর জল কেউ না খাওয়া, বিহার প্রাদেশিক কংগ্রেসে রাজনৈতিক দলাদলি থেকে জাতপাতের দলাদলি প্রকট হয়ে ওঠা, জেলখানার ভেতর বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার জাতপাতের ভিত্তিতে উপদল তৈরি করা ইত্যাদি বিষয়গুলো ছোট ছোট, কিন্তু উপেক্ষণীয় নয়। কেউ কেউ প্রকাশ্যেই বলে, “বামুনকে খাওয়াইয়া, রাজপুতকে বাবুসাব বলিয়া, কায়স্থকে টাকা দিয়া, আর বাকি সব জাতকে প্রহার দিয়া যে কোনো কাজ করাইয়া লওয়া যায়।” গান্ধীজির একনিষ্ঠ সেবক আদর্শবাদী বিলুর বাবাও আশা করেন, বিলুর ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর “হয়তো সুপার বিশেষ খাতির করিয়া ব্রাহ্মণ ওয়ার্ডারদের দিয়া দাহকাজ করাইবে।”
জাগরী লেখক সতীনাথ ভাদুড়ীর প্রথম উপন্যাস। জেলখানায় বসে সাধারণ ডাইরির পাতায় কাঠপেন্সিল দিয়ে এই অসামান্য সৃষ্টিকর্মের জন্য বাংলা চিরায়ত সাহিত্যে অনায়াসে তিনি স্থান করে নিয়েছেন। এই উপন্যাসে বর্ণিত ভারতের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ আমাদের পরিচিত। বিশুদ্ধ আদর্শবাদী বিলুর বাবা কোনো অস্বাভাবিক চরিত্র নন। তাঁর বলয়ের সুকঠিন প্রভাব স্বাভাবিকভাবেই পরিবারে একসময় পর্যন্ত সক্রিয় ছিল – গান্ধীবাদী রাজনীতির সাথে বাম, অতিবাম রাজনীতির যে সংঘাত বিভিন্ন পরিবারকে উত্তাল করেছে, ছিন্নভিন্ন করেছে। বিলুর মা রাজনীতিতে দেখেছেন, “স্বামী স্ত্রীর মধ্যে মনের মিল হয় না, বাপ ছেলেতে ভালোবাসার সম্পর্ক থাকে না, ভাই ভাইয়ের শত্রু হয়ে দাঁড়ায়।” সেযুগে এটা খুব অস্বাভাবিক ছিল না। সতীনাথ ভাদুড়ী নিজে একদিকে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, অন্যদিকে সামাজিক সচেতন ব্যক্তি। কিন্তু লেখকের ব্যক্তিগত রাজনৈতিক জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত-মতাদর্শের সংঘাত কাহিনিকে নিয়ন্ত্রণ করে নি। এক নির্মোহ দৃষ্টিতে তিনি চরিত্রগুলো এঁকেছেন। মৃত্যুকে মহীয়ান করা অপেক্ষা জীবনকে গৌরবান্বিত করাই যেন এই উপন্যাসের ভাষ্য।
৩
জাগরী – সত্যিই আমাকে টানে। জীবন যখন ক্রমাগতই শুকিয়ে আসে, সংক্ষিপ্ত হয়ে আসে, ততই এই টান যেন বেশি অনুভব করা যায়। কয়েক ঘণ্টা পর বিলুর ফাঁসি হবে। ফাঁসি অর্থাৎ মৃত্যু। মৃত্যু অর্থাৎ জীবনের পরিসমাপ্তি। পরিসমাপ্তি অর্থাৎ সমস্তটা অন্ধ যবনিকা। বিলু আদর্শবাদী দেশপ্রেমিক। জীবনটাই তার রাজনৈতিক। রাজনৈতিক জীবনে মৃত্যুদণ্ড স্বাভাবিক একটা ঘটনা। তা নিয়ে হাত-পা ছোঁড়াছুড়ি করে দয়া ভিক্ষা করা বা করুণার পাত্র হওয়া বলিষ্ঠ মানসিকতার লক্ষণ নয়। বিলু সেটা চায় না। বাইরের পৃথিবী জানুক, দেশের জন্য, আদর্শের জন্য, রাজনৈতিক বিশ্বাসের জন্য অকম্পিত হৃদয়ে জীবন দেওয়ার প্রস্তুতি তার রয়েছে। এর কোনোটাই কিন্তু কৃত্রিম বা মিথ্যে নয়। মুক্তির মন্দির সোপানতলে কত প্রাণ এভাবে বলিদান হয়েছে, তা আজ শুধুই ইতিহাস।
কিন্তু,হৃদয়ের খনিতে সত্যের ভেতরেও আরও কিছু সত্য থাকে। যা পরমাণুর মতো লুকানো রয় হৃদয়ের গভীর কন্দরে। আণুবীক্ষণিক পর্যালোচনা ছাড়া যার নাগাল পাওয়া সম্ভব নয়। জাগরী আমাদের নিয়ে যায় চিরন্তন মানব হৃদয়ের সেই গোপন মণিকোঠার সামনে।
বিলুর জীবনের শেষ গোধূলি। দিনের আলো ম্লান হয়ে আসার সাথে সাথে পাখিরা এ-ডাল ও-ডালে ছোটাছুটি করছে। বিলুর জীবনের মতোই, “কিছুক্ষণের মধ্যেই তো চতুর্দিক অন্ধকারে ঢাকিয়া যাইবে। তাহার পর সারারাত নিঝুমের পালা। তাই বোধহয় শেষ মুহূর্তের এত চঞ্চলতা, এত ডানা ঝটপটানি।” বিলু প্রাণভরে এর থেকে আনন্দ নির্যাস পেতে চায়। কতটুকুই বা সময়? তবু “যতটুকু আনন্দ সময়ের নিকট হইতে ছিনাইয়া লওয়া যায়।” এ যেন সেই ঋষি কবির মন্ত্র অনুসরণ – “আনন্দই জীবন।”
দিনের বেলা ফাঁসির সেলের কঠিন লোহার গরাদের মাঝ দিয়ে গাছের একটু সবুজ, একফালি নীল আকাশ বিলুর জীবনের কতবড় পাওয়া তা একমাত্র বিলুই জানে, “আকাশের ঐ ফালিটুকু আমার একান্ত আপন। ও যে আমার নিজস্ব জিনিস। যতক্ষণ দেখা যায় ঐ স্বচ্ছ নীল রঙ দেখিয়া লইয়াছি। এমন করিয়া, আমার মতো করিয়া, আকাশের ঠিক ঐ অংশটুকুকে আর কে পাইয়াছে? আমার নীল আকাশ মুহূর্তে মুহূর্তে রূপ বদলাইতেছে।” কখনো সিঁদুরে, কখনো ধূসর, আবার জমাট অন্ধকার। সবার চোখ, সবার মন সব দেখে না, বা দেখতে জানে না। বিলুর মন রঙ বদলানো আকাশের রঙে-রঙে রঙিন হয়ে ওঠে। বিলুর জীবনের স্পন্দনে স্পন্দনে অধ্বনিত সুর, “আর কী কখনো কবে, এমন সন্ধ্যা হবে?” গাছের সবুজ আর আকাশের এই রঙ ছাড়া আর সবই তো তার কাছে রুক্ষ, বিবর্ণ, মৃত্যুর গন্ধযুক্ত। বিলু একা একাই ভাবে আর হাসে যে, জেল কর্তৃপক্ষ যদি বুঝত ফাঁসি কাঠে ঝোলার অপেক্ষারত তার কয়েদি, গরাদের এইটুকু ফাঁক দিয়ে প্রকৃতি থেকে জীবনের আস্বাদ গ্রহণ করে তবে নিশ্চয়ই সেই সুযোগটুকুও বন্ধ করার উপায় বের করত।
ফাঁসিকে বিলু ভয় পায়। কিন্তু বেঁধে মারলে সবই সয়। ফাঁসির মঞ্চটা ঘষামাজার পর কেমন দেখাচ্ছে আগেই দেখতে ইচ্ছে করছে। মুহূর্তে মুহূর্তে জীবনের ফেলে আসা দিনগুলোর পাতা এলোমেলো উড়ছে। মা-বাবা-নীলু-জ্যেঠিমা-সরস্বতী ছবির মতো ভেসে উঠছে। ভেসে উঠছে পুরনো সব দিন, টুকরো টুকরো স্মৃতি – ঘটনা আর কথা। সব কিছুর মাঝ দিয়েই ব্যক্তি বিলুর দুটি সত্তা সক্রিয়। রাজনৈতিক কর্মী বিলুর সাথে মৃত্যুর ব্যবধান কেবলমাত্র সেলের বদ্ধ একটা দরজা। এই মুহূর্তেও ওয়ার্ডারদের মুখে ‘আসামী’– বা ‘ফাঁসি কাঠ’ – শব্দ শুনতে ভালো লাগে না। চুরি-ডাকাতির অপরাধে তার দণ্ড নয়। দেশ-সেবার জন্য তার দণ্ড। সে তো শহিদের সারিতে পা রাখতে যাচ্ছে। ফাঁসির মঞ্চে জীবনের জয়গান ধ্বনিত হোক, তার মৃত্যুর পর সবাই শোক করুক, সবাই প্রশংসা করুক, সবার মুখে মুখে তার নামে জয়ধ্বনি পড়ুক, তার নামে রাস্তা হোক, আশ্রম হোক, তার মূর্তি স্থাপিত হোক, তিথিতে তিথিতে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য মানুষ আসুক – এমনটাই তো চাওয়া। এই চাওয়ার মধ্যেও জীবনের প্রতি আকাঙ্ক্ষা আছে। দেহাতীত শরীরে দেহধারী মানুষের মাঝে বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা। মানুষ মানুষের জন্য জীবন দেয়। মানুষ দেশের জন্য জীবন দেয়। সব দেওয়ার মধ্যেই হৃদয় গোপনে গোপনে বলে যায়, দেওয়াটাই শেষ কথা নয়, চলে যাওয়াটাই শেষ কথা নয়। থেকে যাওয়াই হোক শেষ কথা। মৃত্যুর পরেও এই থেকে যাওয়ার ইচ্ছে আর আকাঙ্ক্ষা মানুষকে বড় বড় কাজে এগিয়ে দেয়, “বাঁচিবার আকাঙ্ক্ষা আমাকে কোথায় লইয়া যাইতেছে?” কোনো অনির্দিষ্ট শক্তির অমোঘ নির্দেশে কখনো বিলু বিশ্বাস করে নাই। মৃত্যু থেকে রক্ষা পেতে অলৌকিক কোনো ঘটনার প্রত্যাশা তবু যেন অবচেতনে কাজ করছে। আসলে মৃত্যুকে মানতে বাধ্য হওয়া আর মেনে নেওয়ার মধ্যে অনেক অনেক দূরত্ব থেকে যায়।
রাজনীতি বিলুর জীবনসাথী। বাবার মতই আদর্শনিষ্ঠার অহংবোধ তার চারপাশের পরিখা। ছোট থেকে সবার প্রশংসা শুনে বড় হয়েছে – বিলুর মতো ছেলে হয় না। এই প্রশংসার পাহাড় চারপাশে ঠিক রাখতে “মনের কত দুর্নিবার বাসনাকে কশাঘাতে সংযত করিয়াছি।” নিজেকে প্রতিনিয়ত স্বাভাবিক মানবিক চাওয়া-পাওয়া, কামনা-বাসনা থেকে সংযত রাখার এই সাধনার অন্তরালে আরও একটি চাওয়া যে লুকিয়ে ছিল তা শেষ মুহূর্তে এসে বিলু বুঝতে পারছে। ইতিহাসে থেকে যাওয়ার প্রবল তাগিদ। জীবনদানের একটা অর্থ থাকতেই হয়। ভেতরের রক্তমাংসের তরতাজা যুবক ক্রমশই যেন সেই অর্থ খুঁজে ফেরে। ব্যর্থ জীবনকে সফল মনে করার ভাববিলাস তার নেই। জীবনের স্পন্দন খুঁজে বেড়ানোই তার বেঁচে থাকার আনন্দ। লোহার গরাদে আবদ্ধ ১৬ বাই ১৪ হাতের ছোট্ট ঘরটার দেওয়াল আর মেঝের সংযোগস্থলে একটা বুনো নাম না জানা ছোট্ট লতানো গাছ। গাছটাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য বিলুর অপরিসীম আকুতি। ছোট ছোট হলুদ ফুল। নিজের জন্য বরাদ্দ মাপা জল। মুখ কুলকুচি করে গাছটার গোড়ায় দেয়। গাছটি যেন বিলুর জীবনের প্রতীক।
“কী বাঁচিবার আকাঙ্ক্ষা গাছটির। ইঁট আর সিমেন্টের মধ্য দিয়া ফাটল। তাহারই মধ্য দিয়া ইহা জীবনীশক্তি আকর্ষণ করিয়া লইতেছে।” বিলুর মধ্যেও জীবন আর মরণের সামান্য ব্যবধানের মাঝেও জীবনের প্রতি অদম্য ভালোবাসাই এই বিনিদ্র রাতের অপরাজেয় শক্তি। সেলের মধ্যে আবদ্ধ থেকে বাইরের যে কোনো শব্দ, তা মানুষের৷ বা বিড়াল পশু পাখি যারই হোক ভালো লাগে। রেলগাড়ির হুইসেল, স্টিমারের ভেঁপু শুধু দিন-রাতের সময়েরই জানান দেয় না, সেলের সীমিত জগতের সাথে উন্মুক্ত উদার পৃথিবীর সংযোগ তৈরি করে, “প্রাণে জাগায় সুপ্ত মধুর স্মৃতি। রূপ দেয় কত কায়াহীন আকুতি ও বাসনাকে। অনুভব করা যায় বিশাল সীমাহীনতা যেখানে কোনো প্রাচীরের বাধা নাই।” এইসব শব্দ বিলুর কল্পনাবিলাসের সাথী। এরোপ্লেনের শব্দ পরিচিত জগতের শব্দ নয়। মাটির সাথে তার সম্বন্ধ গৌণ। সেই শব্দ তাই মনকে টানে না। বদ্ধঘরের মাঝেও অসহনীয় সময় আর শূন্যতা পূর্ণ হয় জীবনের ছোট ছোট স্পন্দনে। জগতের সাথে সম্পর্ক যত সংক্ষিপ্ত হয়ে আসে, যত জীবনকে নিরর্থক মনে করার কারণ জমে ওঠে, অন্তহীন বিস্মৃতির স্তর থেকে ততই জেগে ওঠে স্মৃতির কঙ্কাল। বিলু ছাড়া আর কারো কাছে তার মূল্য নাই। মা, জ্যেঠিমা, সরস্বতী, নীলু ভেসে ওঠে একের পর এক। নীলুর ব্যবহার তার অজ্ঞাতমন কোনোভাবেই সমর্থন করতে পারছে না, “ইচ্ছা করে বাঁচিতে, ইচ্ছা করে বাকি দুই ঘণ্টার স্বপ্ন বিলাসের মধ্য দিয়া জগৎকে নিঙড়াইয়া, যাহা কিছু ভোগের জিনিস আছে তাহা একত্র করিয়া লইতে।”
জাগরী বাংলা সাহিত্যে চেতনাপ্রবাহ উপন্যাস হিসেবে, রাজনৈতিক উপন্যাস হিসেবে, মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস হিসেবে বহু বিদগ্ধ আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। এই উপন্যাসে বিলুর ফাঁসির আসন্ন মুহূর্তকে ঘিরে বিনিদ্র কোনো চরিত্রই শেষ অবধি অতি মানবীয় নয়। বরং অতি বেশি সাধারণ মানুষ। এখানেই এই উপন্যাসের সৌন্দর্য অনেক বেশি। একমাত্র সারাজীবনের জেদি, গোঁয়ার নীলুর হৃদয়দ্বন্দ্বও গোপন থাকে না।
মৃত্যু নয়, জীবন। জীবনের আনন্দ বিলুর অণু-পরমাণুতে। যে দেশে মৃত্যুদণ্ড নেই, সেই দেশে বিলুর চরম শাস্তি আজীবন কারাদণ্ড হতো। ফাঁসির দড়িতে এভাবে হারিয়ে যাওয়ার থেকে যা অনেক ভালো। বৈচিত্র্যময় ধরণী থেকে যতই বিচ্ছিন্ন থাকা যাক, “জেলের মধ্যেও তো একখণ্ড জগৎ আছে। জেলের মধ্যেও তো শীত গ্রীষ্ম বর্ষার পরিবর্তন অনুভব করা যায়। আকাশ বাতাস চন্দ্র সূর্য তারা সেখানেও মাধুর্য বিলাইতে কার্পণ্য করে না। কালবৈশাখীর মাতলামি, প্রথম বৃষ্টির পর ভিজা মাটির গন্ধ, নিশীথ রাতের বারিধারার মাদকতাভরা রিমিঝিমি, কত স্মৃতিভরা শরতের সোনালী তবকমোড়া রৌদ্র, রহস্যভরা শীতের কুয়াশা, জেলের প্রাচীরের ভেতরেও ইহাদের নিরঙ্কুশ গতি। তাহার উপর মানুষের মুখ দেখা, হউক তাহারা চোর ডাকাত, তবু মানুষ তো?” মানুষের মাঝে মানুষের, প্রকৃতির মাঝে মানুষের বেঁচে থাকার এই চিরন্তন আকুতি দিয়ে ‘লেখকদের লেখক’ সতীনাথ ভাদুড়ী জাগরীর ছত্রে ছত্রে অসাধারণ এক কাব্য রচনা করেছেন। ভাব ও ভাষার ছন্দবন্ধনে মোড়ানো এই অমর জীবনকাব্য ব্রাত্য পাঠকের অনুভূতিকে সম্পূর্ণ মোহময় ও অবশ করে তোলার জন্য যথেষ্ট।
দেবাহুতি চক্রবর্তী
প্রাবন্ধিক, সংস্কৃতি সংগঠক।
Leave feedback about this