Site icon তীরন্দাজ

ছেঁড়া শেকড় | নাদিন গর্ডিমার | ভাষান্তর বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায় | ছোটগল্প

বাবা গিয়েছিল আগেই। আর মা যে কোথায় চলে গেল। বুঝতেই পারলাম না। বলেছিল – দোকান যাচ্ছি। তারপর বিকাল ঢলে পড়ল রাত্তিরের দিকে। অন্ধকার এল। মা এল না। মা এবং বাবা দুজনের চলে যাওয়ার ধরন আলাদা। বাবা যুদ্ধে গিয়েছিল আর ফেরেনি। মা দোকানে।
আমরা প্রতিমুহূর্ত যুদ্ধের ভেতর থাকি। আমি, আমার দাদা, ভাই। বাবার মতো আমাদের হাতে বন্দুক নেই। বাবা যাদের সাথে লড়াই করত তাদের দস্যু বলে। সারা দেশ বলে। সরকার বলে। তারা দাপিয়ে বেড়ায় এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। তাদের ভয়ে আমরা পালিয়ে বেড়াচ্ছিলাম। কিন্তু কতদূর যাব। কোথায় যাব। দুরের পৃথিবী তো আমরা চিনি না।
মা খবর পেয়েছিল দোকানে তেল পাওয়া যাচ্ছে। ছুটে গিয়েছিল শোনামাত্র। কতদিন ভালো করে রান্না হয়নি। আমরাও ভুলে গিয়েছিলাম রান্নার স্বাদ। শুধু নুন মাখানো খাবার খেতে খেতে জিভের উপর শ্যাওলা জমে যাচ্ছিল। অনেক কসরত করে অনেক ঠেলাঠেলি আর ধাক্কাধাক্কির পর মা তেল পেয়েছিল কিন্তু কারা যেন তাকে রাস্তায় ফেলে তেলের বোতলটা কেড়ে নিয়েছিল। হয়তো দস্যুরা। মা আর ফিরে আসেনি।
আমরা বাইরে যেতে ভয় পেতাম। এই বুঝি দস্যুরা তাড়া করল আমাদের। অবশ্য এখন আর সে ভয় ততখানি নেই। তিন বার ওরা আমাদের বাড়িটা আক্রমন করেছিল। প্রথমবার যখন ওরা আসে তখন প্রাণ হাতে নিয়ে আমরা ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে ছিলাম। ঘরে যা ছিল ওরা সব নিয়ে চলে গেছিল। দ্বিতীয়বার যখন এল তখন বাড়িতে কিছুই পেল না , না খাবার না তেল । রাগে ওরা আগুন লাগিয়ে দিল আমাদের ঘরে। দাউ দাউ করে জ্বলছিল বাড়িটা। মা অনেক কষ্টে কিছু টিন জোগাড় করে চারপাশ ঘিরে বাড়ির আদল দিয়েছিল। মাথার উপর আকাশ। এরপর ওরা যখন আসে তখন ব্যর্থ হয়ে ফিরে গিয়েছিল। ভেবেছিল এখানে নিশ্চয়ই কোন লোকজন নেই।
মা নেই। ভয় আরও পেয়ে বসল। মাথার উপর দাদা আছে। কিন্তু সে ও তো তেমন কিছু বড় নয়। ছোট ভাইটা সব সময় কাঁদত খিদেতে। আমি পেটের সাথে তাকে গামছা দিয়ে বেঁধে রাখতাম। যেমন ভাবে ক্যাঙ্গারুর বাচ্চাকে তার থলিতে রাখে মা। এভাবেই কেটেছিল। তারপর আমাদের ঠাকুরদা এবং ঠাকুমা এল গ্রাম থেকে। আমরা একা আছি বলে । মা তেল কিনতে গিয়ে আর ফেরেনি। চিন্তায় অস্থির লাগছিল ঠাকুমার চোখমুখ। তবু ঠাকুরদার চেয়ে ঠাকুমাকে দেখে আমাদের সাহস কিছুটা হলেও বেড়ে গেল। আসলে আমাদের দাদুর চেয়ে ঠাকুমার শারীরিক উচ্চতা এবং গঠন এবং মুখের মধ্যে তেজস্বী ভাব আমাদের মনে জমে থামা ভয় মুছে দিল। ঠাকুমা বলল – এখানে আর কিসের জন্য থাকবি ? চল আমার সাথে চল। আমি মায়ের কথা ভেবেছিলাম যদি ফিরে আসে আর আমাদের দেখতে না পায়। ঠাকুমার নাছোড় আবেদনের কাছে তা ধোপে টেকে নি। আমাদের প্রায় জোর করেই তার বাড়িতে নিয়ে এল। ভাই ঘুমোচ্ছিল ঠাকুমার পিঠে। দাদা ধরেছিল ঠাকুরদার হাত। আমি আস্তে আস্তে ওদের পিছু পিছু হাঁটছিলাম। আমরা সবাই ভয় পাচ্ছিলাম দস্যুদের। ভাই ভয়ের বয়সে পা দেয়নি বলে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছিল। অনেকদিন সেখানে থাকতে হয়েছিল। মা তবু ফিরে আসেনি। এখানে এসেও খাবারের কষ্ট আমাদের কমেনি বরং বেড়েছিল। ভাইকে মাঝে মাঝে একজন মহিলা এসে দুধ খাইয়ে যেত। আমরা বুনো শাক খুঁজতে চলে যেতাম নদী পেরিয়ে গাছের ছায়া পেরিয়ে। কিন্তু আমরা সেখানে যাবার আগেই কেউ তুলে নিয়ে গেছে শাকপাতা।
ঠাকুরদার কিছু ভেড়া , গবাদি পশু আর শস্যক্ষেত ছিল। দস্যুরা তা লুট করে নিয়ে যাওয়ায় এখন সর্বস্বান্ত। ফলে জল খেয়ে আমাদের উপোষ করে থাকা ছাড়া আর কোন রাস্তা ছিলনা। আমরা কাঁদতাম। জমিতে বীজ ফেলার সময় এল। ঠাকুরদা তাও পারল না। কারন ঘরে কোন বীজ অবশিষ্ট ছিল না। তার অশক্ত শরীরের মত বাড়িটাও ভেঙেচুরে যেতে লাগল। তখন ঠাকুমা ঠিক করল এভাবে দিন কাটতে পারে না। দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত আমাদের নিতেই হল। ঠাকুরমাই অবশ্য সিদ্ধান্তটা নিল। আমাদের ঠাকুরদা গুনগুন করে মৃদু স্বরে প্রতিবাদ জানাল। ঠাকুমা পাত্তা দিল না – এই শিশু বাচ্চাগুলো কি অকালে মারা পড়বে ?
আমরা সেই দেশ খুঁজতে লাগলাম যেখানে যুদ্ধ নেই , যেখানে দস্যু নেই। দূরে , অনেক দূরে সেরকম জায়গা নিশ্চয়ই আছে। ঠাকুমা চার্চের পোশাক দিয়ে দিল একজনকে তার বদলে পেল কয়েক মুঠো শুকনো দানা। তা সেদ্ধ করে ঠাকুমা বেঁধে নিল কাপড়ের খুঁটে। আমরা অবাক চোখে তাকালাম তার দিকে – তুমি চার্চে যাবে কীকরে ?

নাদিন গর্ডিমার
১৯২৩ সালের ২০ নভেম্বর তিনি দক্ষিন আফ্রিকার গোয়েটনে জন্মগ্রহণ করেন। বিশ্বের বর্ণবাদবিরোধী সরব যোদ্ধাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। বর্ণবাদকেন্দ্রিক এবং পরবর্তী সময়ের সমস্যা এবং শঙ্কাগুলোই তাঁর সাহিত্যের উপজীব্য বিষয়।লিখেছেন ছোটগল্প , উপন্যাস এবং প্রবন্ধ। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্য তিরিশটিরও বেশি। তার মধ্যে পনেরটি উপন্যাস।বার্গার্স ডটার , দ্য লেট বুর্জোয়া অয়ার্ল্ড , জুলাই’স পিপল এবং মাই সানস স্টোরি ইত্যাদি তাঁর জনপ্রিয় এবং সফল উপন্যাস। ১৯৭৪ সালে দ্য কনজারভেশনিস্ট উপন্যাসের জন্য তিনি বুকার পুরস্কার পান। ১৯৯১ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।নোবেল কমিটি তাঁকে একজন মহৎ মহাকাব্যিক উপন্যাস রচয়িতা হিসেবে আখ্যায়িত করেন। বর্নবাদী সরকারের হাতে বারবার নিষিদ্ধ হয়েছে তাঁর বই। তবু আদর্শে অবিচল থেকেছেন তিনি। ২০১৩ সালে নব্বই বছর বয়সে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

Exit mobile version