শেষ দফার মালামালও চলে গেছে। ভাড়াটে যুবকটি, যার হ্যাটটিতে শোকের চিহ্ন, ঘুরে ঘুরে আবারো দেখছে কিছু ভুলে গেছে কিনা। না, কিছু সে ভোলেনি, একেবারেই না। সে বের হয় হলটিতে, নিজের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যা কিছু তার সাথে ঘটেছে এই বাসায়, তা নিয়ে সে আর ভাববে না। কিন্তু দেখো, হলঘরে টেলিফোনের পাশে একটা অর্ধেক কাগজ আটকানো আর তা পরিপূর্ণ হয়ে আছে নানান লেখায়, কিছু কালো কালিতে, কিছু পেন্সিলে, কিছু লাল কালিতে। সেখানেই লেখা সমগ্র সুন্দর একটা কাহিনি যা ঘটেছে গত দুই বছরের সংক্ষিপ্ত সময়ে। এর যা কিছু সে ভুলতে চেয়েছে তার সবই এখানে বিধৃত – একটা অর্ধেক কাগজে একটা সম্পূর্ণ মনুষ্যজীবন।
সে কাগজটি নামিয়ে নেয়। কাগজটা সেই বিশেষ ধরনের হলদে কাগজ যা বেশ উজ্জ্বল হয়ে থাকে। কাগজটি সে স্টোভের ঢাকনির উপর রাখে আর ঝুকে পরে তা পড়তে শুরু করে।
প্রথমে একটি নাম : এলিস, তার জানা সবচেয়ে সুন্দর নাম, যেহেতু সে ছিল তার জীবনসঙ্গিনী ফলে সুন্দর। আর নাম্বারটি – ১৫১,১, দেখে মনে হয় চার্চে গাওয়া সালমের নাম্বার। এরপর লেখা : ব্যাংক, তার কাজের জায়গা, যে কাজ তাকে দিয়েছিল খাদ্য, ঘর এবং প্রিয়তমা স্ত্রী – তার অস্তিত্বের ভিত্তি। কিন্তু এমন করে বলা বাড়াবাড়িও বটে! কেননা ব্যাংকটি দেউলিয়া হয়েছিল, সে রক্ষা পেয়েছিল অন্য একটা ব্যাংকে গিয়ে, তবে কিছুটা সময় চরম উদ্বেগে কাটানর পর।
এরপরে লেখা : ফুলের দোকান আর সহিসের কথা। তখন তার বাগদানের সময় যখন তার পকেটভর্তি টাকা।
তারপরই : আসবাবের দোকান, ঘরে ওয়ালপেপার লাগানোর লোক। তার সংসারী হওয়া। মালপত্র সরানোর সংস্থা : বাসায় ওঠা।
অপেরার টিকেট ঘর : ৫০.৫০। তারা তখন নববিবাহিত, রোববার করে অপেরায় যেত। তাদের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্তগুলি কাটতো যখন তারা নীরবে বসে থাকতো আর পর্দার পিছনের রূপকথার রাজ্যের সৌন্দর্য ও সম্প্রীতির সাথে একাত্ম হতো।
এরপর এক পুরুষের নাম যা কেটে দেয়া। এক বন্ধুর নাম, যে সমাজে একটা মোটামুটি উঁচু অবস্থানে পৌঁছেছিল, কিন্তু সেই সৌভাগ্য ধরে রাখতে পারেনি। বরং অসহায়ের মতো দুর্ভাগ্য বরণ করেছিল ও বাধ্য হয়েছিল অনেক দূরে চলে যেতে। ভাগ্য এমনি ভঙ্গুর!
এরপর দৃশ্যমান নুতন কিছু, যা ঘটেছে দম্পতির জীবনে। সেখানে লেখা, এক মেয়েলি হাতে ও পেন্সিলে : ‘মিসেস’। কোন মিসেস? – হ্যাঁ, সে-ই যার ওভারকোটটি বেশ বড় আর মুখ সরল জিজ্ঞাসু, যিনি আসতেন চুপি চুপি আর কখনোই হলের ভেতর ঢুকতেন না বরং করিডোর দিয়ে চলে যেতেন শোবার ঘরে।
তার নামের নিচে লেখা ডক্টর ল।
প্রথম বারের মতো এরপর দেখা যাচ্ছে এক আত্মীয়ের নাম। এখানে লেখা ‘মা’। তার শাশুড়ি যিনি নবদম্পতিকে বিরক্ত না করার জন্য নিজেকে নীরবে সরিয়ে রেখেছিলেন, কিন্তু বিপদের সময় তাকে ডাকা হলো আর তিনি সানন্দে চলে আসলেন, কেননা তখন তাকে প্রয়োজন।
এরপর নীল ও লাল রঙে অনেকটা জায়গা জুড়ে এলোমেলো লেখা। কমিশন অফিস : কাজের মেয়ে চলে গেছে বা নুতন কাউকে রাখতে হবে। ফার্মেসি। হুম! অন্ধকার হচ্ছে! দুধের কোম্পানি – সেখান থেকে দুধ নিতে হবে, যক্ষার জীবাণুমুক্ত।
মশলার তাক, কসাইখানা, ইত্যাদি! বাসার খবরাখবর এখন টেলিফোনে, তার মানে গৃহিনী তার জায়গায় নেই। না। কারণ সে শয্যাশায়ী।
তারপরে যা লেখা তা আর সে পড়তে পারে না, কেননা তার চোখে সে ঝাপসা দেখতে শুরু করে, সমুদ্রে ডুবন্ত কেউ যেমন লবণপানির ভেতর দিয়ে দেখে। কিন্তু সেখানে লেখা : সৎকার সংস্থা।
বোঝাই তো যাচ্ছে! একটি বড় ও একটি ছোট শবাধার, বোধগম্য কারণে। ব্রাকেটে লেখা : ধূলি থেকে ধূলিতে
তারপর আর কিছু নেই! ধুলির সাথেই তা শেষ হয়েছে, সেখানেই শেষ।
কিন্তু সে সূর্য রঙের কাগজটি তুলে নেয়, তাতে চুমু খায় আর তার পকেটে রেখে দেয়।
দুই মিনিটে সে যাপন করেছে তার জীবনের গত দুটি বছর।
যখন সে বের হলো, তার মাথা মোটেও নত নয়। বরং তা সোজা ও উঁচু, একজন সুখী ও গর্বিত মানুষের, কারণ সে অনুভব করতে থাকে যে সে পেয়েছিল সবচেয়ে সুন্দর কিছু। কত জন যা কখনো পায় না।
অগুস্ত স্ট্রিন্ডবার্গ (১৮৪৯-১৯১২) সম্ভবত সে-ই সুইডিশ সাহিত্যিক যিনি দেশে ও বিদেশে সমানভাবে খ্যাত। তাঁর নুতন ধারার নাটক আজও পৃথিবী জুড়ে প্রখ্যাত নাট্যমঞ্চগুলিতে অভিনীত হয়। তিনি সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় সৃষ্টিশীল ছিলেন এবং সুইডিশ গদ্যসাহিত্যের আধুনিকায়নে অবদান রেখে গেছেন। চিত্রশিল্পী হিসেবেও তিনি সমধিক খ্যাত।